
রমজানের প্রথম দিনেই জমে উঠেছে ইফতারি বাজার। মুখরোচক খাবারের পসরা সাজিয়ে বসেছেন বিক্রেতারা। শুক্রবার রাজধানীর চকবাজারের ছবি - মাহবুব হোসেন নবীন
‘বড় বাপের পোলায় খায়, ঠোঙায় ভরে লইয়া যায়।’ রমজান এলেই এ রকম বাহারি ইফতারের হাঁকডাকে সরগরম হয় পুরান ঢাকা। চকবাজারের সার্কুলার রোডের শাহি মসজিদের সামনের সড়কে খোলা আকাশের নিচে ঐতিহ্যবাহী মুখরোচক খাবারের পসরা সাজিয়ে রাখেন দোকানিরা। মহামারি করোনাকালে রমজান মাসের চিরচেনা এ দৃশ্য গত তিন বছর অনেকটা হারিয়ে গিয়েছিল। ঐতিহ্য রক্ষায় চকবাজারের এ রাস্তায় গত বছর দোকান বসলেও পরিচিত সেই খাসির আস্ত রানের রোস্ট, রাজহাঁসের ঝাল ফ্রাই, পাতিহাঁস, চীনা হাঁসের ফ্রাই, শাহি জিলাপিসহ অনেক খাবার আর নিত্যসঙ্গী ভিড় ছিল না। তিন বছর পরে এ পুরোনো ইফতার বাজারে ঐতিহ্য ফিরেছে।
গতকাল শুক্রবার রমজানের প্রথম দিনের দুপুর থেকে শাহি মসজিদের সামনের সড়কে সেই দৃশ্য দেখা গেছে। বিকেলে হালকা বৃষ্টি এলেও এই বাজারে কোনো ছেদ পড়েনি।
ভাইরাস সংক্রমণের ভয় কেটে গেছে। পরিস্থিত এখন পুরো নিয়ন্ত্রণে। এর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে ইফতারির বাজারেও। প্রাণ ফিরেছে নানা স্বাদের খাবার আয়োজনে, সরগরম ছিল চকের বাজারগুলো। তবে আকাশচুম্বী নিত্যপণ্য মূল্যের কারণে দামের পারদ উঠেছে এই বাজারেও। এ বছর আস্ত খাসির রানের রোস্ট বিক্রি হচ্ছে ৭০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত। রাজহাঁসের ঝাল ফ্রাই ৩ হাজার টাকা, পাতিহাঁসের ঝাল ফ্রাই ১ হাজার আর চীনা হাঁসের ঝাল ফ্রাই ১ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। শাহি জিলাপি বিক্রি হচ্ছে ২৫০ থেকে ৩৮০ টাকা পর্যন্ত।
গুলশান থেকে ইফতার কিনতে আসা সৈয়দ রিফাত বলেন, প্রতিবছর পুরান ঢাকার এসব খাবারের মাধ্যমে ইফতার শুরু করি। বাবা-দাদারা এই এলাকারই বাসিন্দা ছিলেন। করোনার সময়ে এ সড়কে কেনাবেচা বন্ধ ছিল। তাই এতদিন মুখিয়ে ছিলাম। এবার সুযোগ পেয়েই চারটি খাসির রান, শাহি জিলাপি, বড় বাপের পোলায় খায়সহ অনেক ইফতারি নিয়েছি।
এবার পুরান ঢাকার ইফতারির বাজারের এসব দোকানে আধিক্য ছিল মুরগির রোস্ট, কোয়েল পাখির রোস্ট, কবুতর রোস্ট, ঝাল ফ্রাই, মুরগির কালা ভুনা, গ্রিল, কলিজা, সাসলিক, চিকেন জালি কাবাব, চিকেন সুতি কাবাব, চিকেন পিৎজা, চিকেন ফ্রাই, চিকেন কোপ্তা, গরুর কোপ্তা, টিকা, চিকেন ফ্রাই বার্গার, কাটলেট, রোল, কাবাব, দইবড়া, ফালুদা, ফিরনি, মাঠা, পেস্তাবাদাম শরবত, পরোটা, নানরুটি, দুধ নানরুটি, ঝাল নানরুটি, বিফ নানরুটি, চিকেন নানরুটি, মোগলাই রুটি, সমুচা, শিঙাড়া, জিলাপি, বেগুনি, ছোলাবুট, আলু, বেগুন চপ, ঘুঘনিসহ বাহারি ইফতারির।
আজিমপুর থেকে আসা মামুন হোসেন বলেন, রমজানের ইফতার মানে চকবাজারের খাবার।
মাঝখানে এ ইফতারির বাজার বিধিনিষেধের কারণে বন্ধ থাকলেও ফের জমে উঠেছে। বড় বাপের পোলায় খায়, শাহি জিলাপি, খাসির আস্ত রান আর কোয়েল, কবুতর, রাজহাঁস, পাতিহাঁস, চীনা হাঁসসহ মুরগির আস্ত রোস্টের দোকানির হাঁকডাকে মুখর চকের এ প্রান্তর।
চকবাজারের ইফতারির মধ্যে ‘বড় বাপের পোলায় খায়’ নামে খাবারটি আদি ঢাকার বাসিন্দাদের কাছে জনপ্রিয়। আগে কয়েকটি দোকানে এটি বিক্রি হলেও এ বছর মিলছে কেবল মোহাম্মদ ও তাঁর ভাই রাজু হোসেনের দোকানে। তাঁদের বাপ-দাদারা পুরান ঢাকায় ভারতের এ খাবারের প্রচলন শুরু করেন। সাত দশকের ঐতিহ্যবাহী এ ইফতারসামগ্রী ৩৫ বছর ধরে বিক্রি করছেন বলে দাবি রাজুর।
তিনি জানান, ডাল, চিড়া ভাজা, খাসির কাবাব, খাসির রানের মাংস, খাসির মগজ, খাসির কলিজা, মুরগির মাংস, হাঁসের মাংস, ডিম, আলু ভাজি ও ঘিয়ের সঙ্গে ১২ ধরনের মসলা মিশিয়ে ‘বড় বাপের পোলায় খায়’ তৈরি করা হয়। করোনার আগে এর দাম ছিল ৪৫০ টাকা, গত বছর ছিল ৬০০ টাকা। এ বছর দাম বেড়ে হয়েছে ৮০০ টাকা। তবে এ বছরও গরুর সুতি কাবাব ১ হাজার টাকা, খাসির সুতি কাবাব ১ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
সালেহ আহমেদ নামে আরেকজন জানান, তাঁর দোকানে আছে কবুতর, কোয়েল, মুরগির রোস্ট আর কয়েক পদের নানরুটি। তিনি বলেন, চকবাজারের এ রাস্তায় আগে ছয় থেকে সাতটা ‘বড় বাপের পোলায় খায়’ এর দোকান ছিল। এখন আছে মাত্র একটা।
মন্তব্য করুন