-samakal-64273abb62b24.jpg)
সিলেট ক্যাডেট কলেজের পার্শ্ববর্তী সালুটিকর এলাকায় নির্মিত শহীদ স্মৃতি উদ্যান - সমকাল
একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দেশের অন্য অঞ্চলগুলোর মতো সিলেটেও শত শত নিরীহ ও মুক্তিকামী বাঙালিকে ধরে নিয়ে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী লড়াই শেষে যখন সূর্য উঠেছে স্বাধীনতার, তখনও অনেক স্বজনই জানতেন না শহীদদের ঠাঁই হয়েছে কোথায়। অনেক গণকবরও ছিল অজানা। তেমনি একটি বধ্যভূমি সিলেট শহরতলির সালুটিকরে। সম্প্রতি এটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার শহীদ স্মৃতি উদ্যান, সিলেট’। এতে স্থান পেয়েছে ৬৬ জন শহীদের নামফলক। রয়েছে তাঁদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভও। শহীদদের স্বজনরা এখন স্মৃতি খোঁজেন এ উদ্যানে।
জানা যায়, এ বধ্যভূমিতে কয়েকশ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। দীর্ঘ গবেষণা ও মাঠপর্যায়ে অনুসন্ধানের পর সেখানে গড়ে তোলা হয় শহীদ স্মৃতি উদ্যান। এর অবস্থান সিলেট ক্যাডেট কলেজের পার্শ্ববর্তী শহরতলির সালুটিকর এলাকায়। কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ আব্দুস সালাম বীরপ্রতীক, বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. জিয়াউদ্দিন আহমদ ও তরুণ গবেষক, সাংবাদিক অপূর্ব শর্মা এ নিয়ে কাজ করেছেন। অপূর্ব শর্মার গবেষণা ও তাঁর অনুসন্ধান প্রক্রিয়ার কথা স্মৃতি উদ্যান ফলকে তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘এ নিয়ে আগে কোনো ধরনের গবেষণা না হওয়ায় তাঁর জন্য অনুসন্ধান প্রক্রিয়াটি ছিল দুরূহ। শহীদদের নাম অনুসন্ধানে এ চেষ্টা ছিল এক নতুন বিজয়ের সন্ধানে আত্মত্যাগ। ফলে আজ ৫২ বছর পর স্মৃতির খোঁজ পেয়েছেন তাঁদের স্বজনরা। দেশের বধ্যভূমিতে এ রকম স্মৃতি উদ্যান সিলেটে এটাই প্রথম।’
গত বছর ২০ সেপ্টেম্বর উদ্যানের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন সেনাবাহিনীর সিলেট এরিয়া কমান্ডার ও ১৭ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল হামিদুল হক। এক বিঘা জায়গার ওপর প্রায় ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত স্মৃতি উদ্যানের উদ্বোধন হয় গত ৪ মার্চ। উদ্বোধন করেন শহীদ সৈয়দ সিরাজুল আব্দালের স্ত্রী সৈয়দা সাকিনা আব্দাল। তিনটি ফলকে তুলে ধরা হয়েছে শহীদদের পরিচিতি।
এ বধ্যভূমিতে স্মৃতি উদ্যান নির্মাণের দাবি ছিল সিলেটবাসীর দীর্ঘদিনের। স্থানটি ক্যাডেট কলেজে হওয়ায় সেনাপ্রধানের অনুমতিরও প্রয়োজন ছিল। সেনাবাহিনীর এরিয়া কমান্ডারের বিশেষ উদ্যোগে পরিকল্পনা নেওয়া হয় দুই বছর আগে। গঠন করা হয় স্মৃতি উদ্যান নির্মাণে তিন সদস্যের বাস্তবায়ন কমিটি। বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সালাম, জিয়াউদ্দিন আহমদ ও গবেষক অপূর্ব শর্মাকে কমিটিতে রাখা হয়। নান্দনিক উদ্যানের নকশা করেন স্থপতি শাহরিয়ার আহমদ। নির্মাণকাজে এগিয়ে আসেন আব্দুস সালাম ও জিয়াউদ্দিন।
গবেষণা ও অনুসন্ধানে জানা যায়, তৎকালীন সিলেট রেসিডেনসিয়াল মডেল হাইস্কুল (বর্তমান সিলেট ক্যাডেট কলেজ) এলাকায় বধ্যভূমির অবস্থান। ২০০৭ সালে ক্যাডেট কলেজ কর্তৃপক্ষ পুরো জায়গাটি চিহ্নিত করে। পরে কলেজ কর্তৃপক্ষ সেখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভও নির্মাণ করে। কিন্তু অন্তরালেই থেকে যায় বধ্যভূমিটি। বধ্যভূমি ও সংলগ্ন এলাকায় অগণিত মানুষকে হত্যা করা হলেও ৬৬ জনের পরিচয় জানতে পারে গবেষক দল। গবেষক অপূর্ব শর্মা সমকালকে জানান, পাঁচ দশক আগের ঘটনার বিস্তৃত বিবরণ বের করতে দীর্ঘ অনুসন্ধান চালাতে হয়েছে। ঘুরে বেড়াতে হয়েছে শহরের অলিগলি থেকে গ্রামগঞ্জে।
শহীদ বাছির মিয়ার মেয়ে তাহমিনা খাতুন তান্নী জানান, যেখানে বাবা আত্মাহুতি দিয়েছেন সেই স্থানে প্রথমবারের মতো ভাইকে নিয়ে গিয়েছিলেন। এতকাল মানিক পীর (রহ.) এর মাজার কবরস্থানে গিয়ে জিয়ারত করতেন। এখন জানতে পেরেছেন তাঁর বাবাকে সালুটিকর এলাকায় হত্যা করা হয়েছিল। এখন থেকে সেখানে গিয়ে তাঁর পিতার জন্য চোখের জল ফেলতে পারবেন।
শহীদ স্মৃতি উদ্যানের উদ্যোক্তা কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ আব্দুস সালাম জানান, বধ্যভূমিটি আমাদের কেবল আত্মদানের স্মৃতি নয়, এটি আবেগের। দীর্ঘ পরিকল্পনার পর তা বাস্তবায়ন করতে পেরে আমরা আনন্দিত।
মন্তব্য করুন