- বাংলাদেশ
- প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের আগাম জামিন
প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের আগাম জামিন

আদালত চত্বরে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান (ছবি-ফোকাস বাংলা)
ঢাকার রমনা থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলায় প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানকে ছয় সপ্তাহের আগাম জামিন দিয়েছেন হাইকোর্ট। বিধি অনুযায়ী এর পর তাঁকে ঢাকার বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করতে হবে।
রোববার বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. আমিনুল ইসলাম সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই জামিন মঞ্জুর করেন। আগাম জামিন শুনানির সময় মতিউর রহমান আদালতে উপস্থিত ছিলেন। তাঁর পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ফিদা এম কামাল ও আইনজীবী জেড আই খান পান্না।
এ ছাড়া প্রথম আলোর পক্ষে আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, ইমতিয়াজ মাহমুদ ও প্রশান্ত কর্মকার উপস্থিত ছিলেন। অন্যদিকে, রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ মেহেদী হাসান চৌধুরী ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সুজিত চ্যাটার্জি বাপ্পী।
রোববার সকালে মতিউর রহমান আগাম জামিন চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেন। দুপুরে একটি বেঞ্চে ওই আবেদনটি শুনানির জন্য উপস্থাপন করা হয়। তবে আগাম জামিন আবেদন শুনানির এখতিয়ার না থাকায় বেঞ্চ ওই আবেদনটি ফেরত দেন। এর পর বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলামের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চে আবেদনটি দাখিল করা হয়। বিকেল ৩টার দিকে শুনানি শুরু হয়।
আইনজীবী ফিদা এম কামাল আদালতকে বলেন, যে অভিযোগ প্রথম আলোর বিরুদ্ধে আনা হয়েছে, তা সঠিক নয়। বিষয়টি একাত্তর টিভির একজন সাংবাদিক পলিটিক্যালি মোটিভেটেড হয়ে রিপোর্ট করে সবাইকে বিভ্রান্ত করেছেন। মতিউর রহমানকে এভাবে হয়রানি করার মানে হয় না। প্রথম আলোর অনলাইনে দিনমজুরের উদ্ধৃতি ছাপা হয়েছিল, সেখানে শিশু সবুজের কোনো নাম ছিল না। এ সময় আদালত বলেন, ‘আমরা মনে করি, প্রথম আলো বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশ করে। তাদের স্লোগান আছে, সত্যের সন্ধানে। তারা যদি এ রকম ভুল করেন, দায়িত্বশীলতার পরিচয় না দেন, তাহলে কেমনে হবে?’
তখন ফিদা এম কামাল বলেন, ‘আমরা তো ভুল করিনি। বিষয়টি একাত্তর টিভির একজন সাংবাদিক পলিটিক্যালি মোটিভেটেড হয়ে রিপোর্ট করে সবাইকে বিভ্রান্ত করেছেন। এ ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী যে মামলাটি করেছেন, তিনি কীভাবে এখানে সংক্ষুব্ধ হলেন, সেটাই তো বুঝলাম না। আমরা মনে করি, ডিজিটাল আইনের মামলাটি এখানে প্রয়োগযোগ্য নয়।’
এ পর্যায়ে প্রথম আলোর আইনজীবী জেড আই পান্না মামলা করার ক্ষেত্রে বাদীর এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি আদালতকে বলেন, এজাহারে মামলার বাদী প্রথম আলোর গত ৬ মার্চের রিপোর্টের সঙ্গে ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষের সময় ইত্তেফাকে প্রকাশিত বাসন্তীর ঘটনার তুলনা করেছেন। বাদীর তখন বয়স কত ছিল? তিনি কীভাবে প্রথম আলোর প্রতিবেদনের কারণে সংক্ষুব্ধ হলেন, ক্ষতিগ্রস্ত হলেন? এগুলো আদালতের বিবেচনা করা দরকার। তখন আদালত বলেন, তাহলে বাদী বাসন্তীর খবর পাইলো কেমনে? তবে আমরা বাসন্তীর খবর জানি। এই খবর পত্রিকায় আসার পরেও কিন্তু কেউ তার পাশে দাঁড়ায়নি।
এ সময় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সুজিত চ্যাটার্জি বাপ্পী বলেন, ‘আমি নিজেও প্রথম আলোর পাঠক। প্রথম আলো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের, অসাম্প্রদায়িকতার পক্ষের পত্রিকা। কিন্তু এসব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে কী কাজটি প্রথম আলো করল? রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সারা বিশ্বের অর্থনীতি টালমাটাল হলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, সেখানে সাত বছরের সবুজের হাতে ১০ টাকা ধরিয়ে দিয়ে ছবি তুলেছে। পরে এটি প্রত্যাহার করলেও যা ক্ষতি করার তারা তা করে দিয়েছে। সারা বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে।’
আদালত বলেন, ‘যেহেতু তারা একটি সংশোধনী ছাপিয়েছে, আর আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার সবার রয়েছে।’
এ সময় সুজিত চ্যাটার্জি বাপ্পী বলেন, ‘প্রথম আলোর রিপোর্টার শামসুজ্জামান কারও দ্বারা মোটিভেটেড হয়ে দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ করেছেন। কারও দ্বারা ব্যবহৃত হয়েছেন। দেশের ও সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট এবং দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য তাঁরা এ কাজ করেছেন। প্রথম আলোর মতো পত্রিকা যদি এ কাজ করে, তাহলে দেশ কোথায় যাবে?’
এক পর্যায়ে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ মেহেদী হাসান চৌধুরী বলেন, ‘প্রথম আলোর বিরুদ্ধে এ অভিযোগ তো সরকার করেনি। আরেকজন সাংবাদিকের প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।’
তখন আদালত বলেন, ‘অভিযোগ নিয়ে তো প্রেস কাউন্সিলে যাওয়া যেত।’
অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘তাঁরা ভুল করলেন, আবার প্রত্যাহার করলেন। বিষয়টি এমন যে, পকেট মেরে আবার টাকা ফেরত দিলেন।’
আদালত বলেন, ‘ভুলটা নজরে আসার পর তো তাঁরা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।’ শুনানি শেষে আদালত মতিউর রহমানকে ছয় সপ্তাহের আগাম জামিন দেন।
গত ২৯ মার্চ মধ্যরাতে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়। রাজধানীর রমনা থানায় করা এ মামলায় সাভারে প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামান শামস এবং সহযোগী ক্যামেরাম্যানসহ অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদেরও আসামি করা হয়েছে। মামলার বাদী আইনজীবী আবদুল মালেক (মশিউর মালেক)। শামসুজ্জামান শামসের বিরুদ্ধে একই ঘটনায় আরও একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার করে এরই মধ্যে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
গত ২৬ মার্চ একটি ফটোকার্ডে একজন দিনমজুরের বক্তব্য উদ্ধৃত করে প্রতিবেদন প্রকাশ করে প্রথম আলো। ওই প্রতিবেদনে শিশুর ছবি প্রকাশের অসংগতির বিষয়টি নজরে এলে ১৭ মিনিটের মধ্যেই তা (ফটোকার্ড) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে প্রত্যাহার করে সংশোধনী দেয় প্রথম আলো। এর পরও দেশে-বিদেশে বিভিন্ন মহলে প্রথম আলোর প্রতিবেদন এবং প্রতিবেদনকে কেন্দ্র করে মামলা দায়ের নিয়ে নানামুখী প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের করার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘসহ কূটনৈতিক মহল।
মন্তব্য করুন