নওগাঁয় র‍্যাব (র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন) হেফাজতে সরকারি কর্মচারী সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর ঘটনার সঙ্গে যুগ্ম সচিবের সম্পৃক্ততা বিষয়ে রাজশাহীর বিভাগীয় কমিশনার জিএসএম জাফরুল্লাহ পর্যাপ্ত তথ্য দেননি। প্রকৃত তথ্য গোপন করে প্রাথমিক প্রতিবেদন দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে। সরকারের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্রে এমন তথ্য মিলেছে।
কমিশনার অফিস থেকে দেওয়া প্রতিবেদনে মূল ঘটনা আড়াল করার কারণে যুগ্ম সচিবের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত ব্যবস্থা নিতে পারছে না মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ বা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। বিভাগীয় কমিশনারের কাছে গতকাল সোমবার এসব বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন।
রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ে পরিচালক (স্থানীয় সরকার) হিসেবে কর্মরত যুগ্ম সচিব এনামুল হক। র‍্যাব হেফাজতে মারা যাওয়া সুলতানা জেসমিন নওগাঁ সদর উপজেলার ভূমি অফিসের কর্মচারী। গত ২২ মার্চ সুলতানাকে র‍্যাব তুলে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ তাঁর স্বজনদের। এর পর র‍্যাব হেফাজতে থাকা অবস্থাতেই ২৪ মার্চ  মারা যান তিনি। র‍্যাবের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়, যুগ্ম সচিব এনামুলের উপস্থিতিতেই সুলতানাকে আটক ও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

র‍্যাবের সংবাদ সম্মেলন, যুগ্ম সচিবের মন্তব্যসহ গণমাধ্যমে প্রকৃত তথ্য উঠে আসার পরও ওই যুগ্ম সচিবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনারের অফিস সূত্রে জানা গেছে, ঘটনার দিন এনামুল হকের নওগাঁ জেলায় কোনো কর্মসূচি ছিল না। নওগাঁ জেলা বা উপজেলাতেও তাঁর সফর সম্পর্কিত তথ্য ছিল না। তারপরও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে তিনি কীভাবে অন্য জেলায় অপারেশনে গেলেন– সে হিসাব কেউই মেলাতে পারছেন না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক অতিরিক্ত সচিব জানান, হয়তো ওই নারী মারা না গেলে এই ঘটনা আলোচনায় আসত না। তার পরও একজন যুগ্ম সচিব মর্যাদার কর্মকর্তা সরকরি নির্দেশ ছাড়া কোনোভাবেই এমন অভিযানে যেতে পারেন না। যুগ্ম সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা সচিবালয়ে নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। সেখানে এমন তুচ্ছ কাজে নিজেকে জড়ানোর ঘটনায় মন্ত্রপরিষদ বিভাগ বা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। এটা মাঠ প্রশাসনের শৃঙ্খলার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানায়, এনামুল হক নিজেও একটি প্রতারণা মামলার আসামি। ঢাকার মোহাম্মদপুর থানায় তাঁর বিরুদ্ধে টাকা নিয়ে চাকরি না দেওয়ার অভিযোগে মামলা রয়েছে। যদিও মামলার বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি। এই ঘটনার সঙ্গে এনামুলের আগের কর্মস্থলগুলোতেও কোনো আপত্তিকর ঘটনা আছে কিনা, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
সূত্র আরও জানায়, বিভাগীয় কমিশনারের পক্ষ থেকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো প্রাথমিক প্রতিবেদনে সুলতানাকে গ্রেপ্তার-সংক্রান্ত ঘটনায় যুগ্ম সচিবের সম্পৃক্ততার তথ্য নেই। কিন্তু এ ঘটনায় যুগ্ম সচিব ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন– সেটা বিভাগীয় কমিশনার জানতেন। আলোচ্য নারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ বিষয়েও বিভাগীয় কমিশনারকে আগে থেকে অবহিত করেছিলেন যুগ্ম সচিব এনামুল হক। ঘটনাটি আগে থেকে জানার পরও বিভাগীয় কমিশনার কেন আনুষ্ঠানিকভাবে মন্ত্রিপরিষদকে জানাননি– সে প্রশ্ন উঠেছে। এ ঘটনায় প্রাথমিক রিপোর্টে বিভাগীয় কমিশনারের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত তথ্য না থাকায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে রাজশাহীর বিভাগীয় কমিশনারকে আবারও প্রতিবেদন পাঠাতে বলা হয়েছে।

উল্লেখ্য, সুলতানার মৃত্যুর পর গত ২৮ মার্চ ঢাকায় র‍্যাবের পক্ষ থেকে দেওয়া আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় বাহিনীর আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানিয়েছিলেন, সুলতানা জেসমিনকে র‍্যাব আটক করার সময় যুগ্ম সচিব সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তাঁর উপস্থিতিতেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

এক মন্ত্রণালয় তাকিয়ে অন্য মন্ত্রণালয়ের দিকে: যুগ্ম সচিবের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে এক মন্ত্রণালয় আরেক মন্ত্রণালয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। সরকারের কোনো মন্ত্রণালয় ও বিভাগের পক্ষ থেকে কার্যকরী কোনো উদ্যোগ গতকাল পর্যন্ত দেখা যায়নি। ঘটনাটি মাঠ প্রশাসনের বিষয় হওয়ায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কোনো ভূমিকা না দেখে সচিবালয়ের অনেক কর্মকর্তাই অবাক হচ্ছেন। তাঁরা বলছেন, মাঠ প্রশাসনে কোনো অ্যাকশন নিতে হলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ নির্দেশ দেবে। আর সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। অন্যদিকে জনপ্রশাসন-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ওপর থেকে নির্দেশ এলে তাঁরা উদ্যোগ নেবেন। সংশ্লিষ্ট আরেকজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, যুগ্ম সচিব এনামুল হক রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনারের অফিসে পরিচালক (স্থানীয় সরকার) হিসেবে কর্মরত থাকায় তাঁর নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। তাই তাঁর বিষয়ে স্থানীয় সরকার থেকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় কিনা, সেদিকে নজর রাখছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। আবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, মারা যাওয়া কর্মচারী ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীন। তাই তারাও কোনো তদন্ত করে কিনা, সেটাও দেখতে হবে।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মাঠ প্রশাসনে কাজ করে গেছেন, এমন একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সমকালকে বলেন, মারা যাওয়া নারী নিম্ন গ্রেডের কর্মচারী হওয়ায় কিছুই হচ্ছে না। যদি ক্যাডার কর্মকর্তা হতেন তাহলে দেখতেন– কী হয়। এ সময় উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, কক্সবাজারে সাবেক একজন মেজর পুলিশের হাতে মারা যাওয়ার ঘটনা নিশ্চয় সবার মনে আছে। নওগাঁয় পিয়ন মারা যাওয়ার কারণেই প্রশাসনে নড়াচড়া নেই। একটু ওপরের গ্রেডের কর্মচারী হলেই মন্ত্রিপরিষদ থেকে তদন্ত কমিটি এত দিনে মাঠে থাকত। এনামুল হকও প্রত্যাহার হতেন।

এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (মাঠ প্রশাসন) হেলাল মাহমুদ শরীফ সমকালকে বলেন, ঘটনাটি বিষয়ে বিভাগীয় কমিশনারের কাছে বিস্তারিত তথ্য চাওয়া হয়েছে। রিপোর্ট আসার পর আমরা পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেব।