
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই সমিতিকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই ‘উপাচার্যের দায়’ এই বক্তৃতামালায় কিছু বলার সুযোগ দেওয়ার জন্য। উপাচার্যের দায়িত্ব ও কর্তব্য অত্যন্ত পরিষ্কার। যে আইনে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হয়, সেই আইনেই এই কর্তব্য ও দায়িত্বের বর্ণনা পাওয়া যাবে। ৫০-৬০ বছর ধরে এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের রদবদল কম হয়নি। কিন্তু উপাচার্যের দায়িত্ব ও কর্তব্যবিষয়ক অংশটি মোটামুটি অপরিবর্তিত আছে। এবং অলিখিত হলেও এটা পরিষ্কার, কর্মকর্তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘চিফ একাডেমিক অ্যান্ড এক্সিকিউটিভ অফিসার’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তিনি সব ধরনের উদ্ভূত সমস্যা সমাধানে প্রস্তুত থাকবেন– এটাই এর নিহিতার্থ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপরেখা প্রতি দশকেই কিছু না কিছু বদলে যাচ্ছে। আর সেই সঙ্গে বদলে যাচ্ছে একই নামের আড়ালে যে ব্যক্তিটি কাজ করে যাচ্ছেন, তাঁর দায়িত্ব, সমস্যা ও কর্মধারা। আমাদের জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রেই পরিবর্তন ঘটে চলছে। সাতচল্লিশ থেকে ছিয়াশি– প্রায় ৪০ বছর এ দেশে একের পর এক উপাচার্যের ভূমিকা দেখার সুযোগ আমার হয়েছে, কখনও কাছে থেকে, কখনও দূরে থেকে। এবং এরই মধ্যে প্রায় আট বছর এই ভূমিকা পালনও করতে হয়েছে। সব মিলিয়ে এই অভিজ্ঞতাটা হলো কিছুটা পেছনের সারির দর্শকের, কিছুটা সামনের সারির দর্শকের এবং কিছুটা অভিনেতার। শুধু যদি অভিনেতার কথা বলে শেষ করি, তাহলে বক্তব্য অসম্পূর্ণ থাকবে। আবার ফিরে এসেছি দর্শকের ভূমিকায়। চেষ্টা করব এ দেশে এ মুহূর্তে একজন উপাচার্যের ভূমিকা আমার চিন্তায় কীভাবে ধরা দিচ্ছে, সেই কথাটা বলতে। এই প্রচেষ্টায় আমার অভিনয়ের অভিজ্ঞতা যতই গুরুত্বপূর্ণ হোক, তার আগে ও পরে আমার দর্শকের ভূমিকাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বলা বাহুল্য, অভিনেতা যে, সে আসল দৃশ্যটা দেখে না; দেখে দর্শক।
এই উপমহাদেশের উচ্চশিক্ষার ইতিহাসে ব্রিটিশের দেওয়া দান অত্যন্ত স্পষ্ট অনপনেয়। এই ছাপের একটি দিক হলো, প্রথম থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ‘অটোনমাস’ বা স্বায়ত্তশাসিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ ও ব্যবস্থাপনায় সরকারের উপস্থিতি বরাবরই আছে। তবে প্রত্যক্ষভাবে নয়। একটি নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে অভ্যন্তরীণ প্রায় সব ব্যাপারেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যথেষ্ট স্বাধীনতা ভোগ করে এবং করে আসছে। উপাচার্য নিয়োগেও একই কথা। যদিও চ্যান্সেলরই উপাচার্য নিয়োগ করেন, তবে যাকে খুশি তাকে নয়। এক সময়ে এই পদে হাইকোর্টের বিচারপতিরাও নিযুক্ত হয়েছেন, এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নন বা ছিলেন না, এমন ব্যক্তিকে উপাচার্যের পদে কদাচিৎ দেখা যায়। উত্তর আমেরিকার সংজ্ঞায় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় সবগুলোই স্টেট ইউনিভার্সিটি বা সাদা কথায় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। যেহেতু এ দেশে প্রাইভেট সেক্টরে বিশ্ববিদ্যালয় নেই– হয়তো শিগগিরই তাঁর সুযোগও সৃষ্টি হবে– তাই ওই কথাটা চালু হয়নি।
বিগত দশকগুলোতে এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য সবাইকে এক বিশেষ পরিস্থিতির মধ্যে কাজ করতে হয়েছে। অত্যন্ত মোটাদাগে এই পরিস্থিতির ছবি আঁকা যায়। রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং অবশ্যম্ভাবী ফল যুবসমাজে ক্ষোভ ও চাঞ্চল্য এই পরিস্থিতির অবয়ব রচনা করেছে। সমাজদেহের সবচেয়ে স্পর্শকাতর, সবচেয়ে সংবেদনশীল অঙ্গ হলো বিশ্ববিদ্যালয়। যে ভাবনা, যে অস্থিরতা সমাজের অন্যত্র একটা ক্ষীণ স্পন্দন তোলে, তা-ই ঢেউয়ের মূর্তি গ্রহণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে। পাকিস্তানি শাসনামলে রাজনৈতিক অঙ্গনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ওপর যে অন্যায় হয়েছিল, তাঁর তীব্রতম প্রতিক্রিয়া ও প্রতিবাদ হয়েছে ছাত্রমহলে। বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়ে। ওই সময়ে উপাচার্যকে দুই কূল রক্ষা করতে প্রাণান্তকর পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হয়েছে। সরকার চেয়েছেন উপাচার্য শান্তি রক্ষা করবেন এবং সরকারের শর্তেই তা করবেন। যিনি তা-ই করতে চেয়েছেন, তাঁর ভাগ্যে জুটেছে সরকারের পক্ষ থেকে পুরস্কার ও সমাজের হাতে নিন্দা ও তিরস্কার।
উপাচার্য একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা। শুধু নীতিনির্ধারণের মধ্যে তাঁর দায়িত্ব সীমাবদ্ধ থাকছে না। প্রশাসনিক বিবর্তনের ধারায় তিনি ক্রমান্বয়ে প্রতিদিনের প্রশাসনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। এই পরিবর্তন একদিনে ঘটেনি এবং বিচ্ছিন্নভাবে বিশ্ববিদ্যালয়েই ঘটেনি। আমার ধারণা সারাদেশেই প্রশাসনের চরিত্র বদলে গেছে এবং নীতিনির্ধারণের প্রয়োজনীয় দূরত্বে যাঁদের অবস্থান হওয়ার কথা, পরিস্থিতি তাঁদের নির্বাহী স্তরে টেনে নামিয়েছে। আমার মতে, এটা উপাচার্যের পদের একটা গুণগত পরিবর্তন এবং এই পরিবর্তনের শিকার হয়ে উপাচার্য তাঁর মৌলিক ভূমিকা থেকে ভ্রষ্ট হয়েছেন। এই পরিবর্তন ইচ্ছাকৃত বলে মনে হয় না। এটা পরিবেশসম্ভূত। দেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় যা ঘটেছে, সর্বস্তরে তারই ‘আছর’ পড়েছে। নিজ প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে দায়িত্ব বণ্টন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের পুরোনো ধারণা ও পুরোনো ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও তা থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারেনি।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের শীর্ষে উপাচার্যের অবস্থান, প্রশাসনের সব ক্ষমতার তিনি কেন্দ্রবিন্দু। এই পরিস্থিতির যে প্রতীকী তাৎপর্য, সেটা যতদিন অক্ষুণ্ন ছিল ততদিন উপাচার্য একই সঙ্গে তাঁর প্রয়োজনীয় দূরত্ব ও তাঁর কার্যকারিতা রক্ষা করেছেন। প্রতীকী তাৎপর্য বলতে এই বুঝি যে, নীতিনির্ধারণ, ক্ষমতা ও দায়িত্ব বণ্টনের স্পষ্ট ও ন্যায়সংগত একটা কাঠামোর মধ্যে উপাচার্য কাজ করবেন। উপাচার্য একা নন, নীতিনির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের একটা বিধিবদ্ধ ব্যবস্থা আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ধারায় আছে ফ্যাকাল্টি ও একাডেমিক কাউন্সিল। প্রশাসনিক ধারায় আছে স্থায়ী প্রশাসনের বিভিন্ন স্তর ও বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা। মূলনীতি পর্যালোচনা ও দিক নির্দেশের জন্য আছে সিনেট এবং নির্বাহী পর্যায়ে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সিন্ডিকেট। পুরো প্রশাসনিক ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রটি হলো সিন্ডিকেট, উপাচার্য যার সভাপতি। শিক্ষাগত ও প্রশাসনিক সব সিদ্ধান্তই সিন্ডিকেটের। উপাচার্য সিন্ডিকেটকে প্রভাবিত করতে পারেন এবং সিন্ডিকেট দ্বারা প্রভাবিত হতে পারেন। প্রচলিত আইনে তিনি সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত অগ্রাহ্য করতে পারেন না এবং কোনো প্রশ্নে সিন্ডিকেটের সঙ্গে তাঁর দ্বিমত হলে সিন্ডিকেটের কোনো সিদ্ধান্তকে তিনি বড়জোর কিছুদিন বিলম্বিত করতে পারেন। তবে শেষ পর্যন্ত সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। এটা একটা গণতন্ত্রসম্মত ও নিশ্চিন্ত ধারণা। তবে এই ধারণার মধ্যে ছিদ্র নয়, রীতিমতো ফাটল দেখা দিয়েছে এবং সেখানেই প্রশাসনিক বিপর্যয়ের উৎস। প্রশাসনের এই ক্ষমতার উৎস সিন্ডিকেটের স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ ক্রমেই সংকুচিত হয়ে এসেছে। এটা শুধু আমার ব্যক্তিগত ধারণা নয়, বিশ্ববিদ্যালয় মহলে এই ধারণাই এখন প্রতিষ্ঠিত। সিন্ডিকেটের শিক্ষক প্রতিনিধিরা সবাই নির্বাচিত এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকমণ্ডলী তাঁদের নির্বাচন করেন। যখন থেকে এই ব্যবস্থা চালু হয়েছে তখন থেকেই সিন্ডিকেটের এই শিক্ষক সদস্যরা তাঁদের রাষ্ট্রীয় স্বার্থের মুখপাত্র। তাঁদের নিরপেক্ষতা তখন থেকেই বাধাগ্রস্ত। নিরপেক্ষতা নষ্ট হলে সেই শূন্যস্থান পূরণ করে যে বস্তুটি, তার নাম পক্ষপাতিত্ব। পক্ষপাতিত্বের অভিযোগমুক্ত সিন্ডিকেট ক্রমেই দুর্লভ ও দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে।
আমার মনে হয়, যাঁরা ১৯৭৩-এর বিশ্ববিদ্যালয় আইন তৈরি করেছিলেন, তাঁরা সদিচ্ছার বশবর্তী হয়েই বিভিন্ন পর্যায়ে নির্বাচনের ব্যবস্থাকে প্রবর্তন করেছিলেন। এর পরিণতি যে এমন হবে, তা ভাবতে পারেননি। তা ছাড়া পাকিস্তানের বছরগুলোতে যাঁরা উপাচার্য, ফ্যাকাল্টির ডিন ও বিভাগীয় প্রধানকে সরকারের সহযোগী বা কমসে কম কায়েমি স্বার্থের প্রতিনিধি ভাবতে অভ্যস্ত হয়েছিলেন; তাঁদের এই ভাবনা একেবারে ভিত্তিহীন ছিল না। একটা সম্ভাবনাকে নষ্ট করতে গিয়ে তাঁরা অন্যান্য সম্ভাবনার পথ খুলে দিয়েছিলেন। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিগত দেড় দশকে সংখ্যাগুরুর শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পদোন্নতির প্রতিযোগিতা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং উপাচার্যের বড় দায় হয়ে পড়েছে তাঁর শিক্ষকসমাজ। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার মতো তিনি গলবস্ত্র হয়ে প্রায়ই নির্বাচকমণ্ডলীর সামনে করজোড়ে উপস্থিত হচ্ছেন। পরমুখাপেক্ষিতার এই মূল্য তাঁকে, ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক, দিতে হচ্ছে। যিনি এই দায়িত্ব স্বীকার করেন না, অর্থাৎ যিনি কোনো মহলের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নন, যিনি পদোন্নতির প্রশ্নকে বিচারকের দৃষ্টিতে দেখবেন, উকিলের দৃষ্টিতে নয়, তিনি শিক্ষকসমাজের বন্ধু নন– এই অপবাদ তাঁকে মেনে নিতে হবে।
ফজলুল হালিম চৌধুরী: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য
মন্তব্য করুন