নব আনন্দে জাগো– এই স্লোগান বুকে ধারণ করে প্রতি বছরের মতো এবারও ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী শিশু পার্ক প্রাঙ্গণে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করেছে। আবহমান বাংলার হাজার বছরের কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় বাঙালি বরণ করে নতুন বছরকে। এ বছর নববর্ষ উদযাপনের ঐতিহ্যের ৪০ বছর পূর্ণ করেছে ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী। ঋষিজ প্রগতির পক্ষে দৃঢ় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে গণশক্তির মহতী উদ্যোগের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে গেয়ে যাচ্ছে নবজীবনের গান। সব বাধা ঠেলে ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী ৪৭ বছরে পদার্পণ করেছে। ২০২১ সালের ২৩ জুলাই আমাদের অভিভাবক ঋষিজের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি গণমানুষের গায়ক ফকির আলমগীর না ফেরার দেশে চলে যান, যাঁর গগনবিদারী কণ্ঠ পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে এক ভিন্ন আবহের সৃষ্টি করত। আমরা এই বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখের জন্য অপেক্ষায় উন্মুখ থাকি। এ এক মিলনমেলা। নূতনের কেতন উড়িয়ে বাঙালির ঘরে ঘরে আহ্বান জানায় পহেলা বৈশাখ। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালি মেতে ওঠে পহেলা বৈশাখ এলেই।

রমনার বটমূলের ছায়ানটের ভোরের অনুষ্ঠান যেমন ঐতিহ্যবাহী তেমনি ঋষিজও এই ঐতিহ্যবাহী বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠানটি বিগত ৪০ বছর ধরে একই স্থানে শিশু পার্কের নারকেলবীথি চত্বরে গৌরবের সঙ্গে উদযাপন করেছে। ঋষিজের অনুষ্ঠানে বাঁশির সুরে গেরুয়া বসনে নববর্ষের প্রভাতি অনুষ্ঠানে ফকির আলমগীর যেন বাংলার এক মূর্ত প্রতীক হয়ে আবির্ভূত হতেন। গানে গানে দর্শক-শ্রোতা মাতিয়ে তুলতেন। এখানেই এই গণগায়কের সার্থকতা। স্বাদেশিকতার চেতনায় আন্তর্জাতিকতার মহাসমুদ্রে অবগাহন করতেন ফকির আলমগীর। এই গণগায়কের অবয়ব বাংলার ঐতিহ্যের ধারক ফকির আলমগীর ঘরে ঘরে সমাদৃত এক প্রিয় মুখ। এখানেই তাঁর শিল্পী-জীবনের সার্থকতা। তাঁর নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস ছিল বাংলা ঘিরে। তাই তো মহান মুক্তিযুদ্ধে ২১ বছর বয়সে দেশমাতৃকা বাংলার অস্তিত্বকে রক্ষায় শত্রুর মোকাবিলায় অংশগ্রহণ করেন। স্বাধীন বাংলা বেতারের একজন বলিষ্ঠ কণ্ঠের অধিকারী ফকির আলমগীর উজ্জীবিত করেছেন গানে গানে বাংলার মানুষকে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানবকল্যাণে নিবেদিত। এই ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী তাঁর প্রতিষ্ঠাতা প্রাণপুরুষের আদর্শ সামনে রেখে পথ চলছে নিরলস। অধ্যাত্মবাদের আবেগের সঙ্গে যুক্তিযুক্ত-জীবনবাদী চেতনার এক অদ্ভুত, অপরূপ সংমিশ্রণ ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন ফকির আলমগীর।

বাঙালি জাতিসত্তার অনন্য অংশ পহেলা বৈশাখ। এ শুধু বর্ষবরণ নয়, এর পেছনে রয়েছে বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, চেতনাসহ অনেক কিছু। আমরা বাঙালি। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। বাংলা ভূখণ্ডের নিজস্ব সংস্কৃতি এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে। সবাই মিলে আমরা বাঙালি। সারাবছর বাংলা সংস্কৃতির মধ্যেই আমরা থাকি। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে বাঙালির নববর্ষ ভিন্নমাত্রা লাভ করেছে। বাঙালি সংস্কৃতির বৈচিত্র্য, অসাম্প্রদায়িক মানবিক বোধ বাঙালি জাতিসত্তার অন্যতম উপাদান হিসেবে এক শিকড়সন্ধানী প্রেরণা মানুষকে আগ্রহী করে তোলে। এ উৎসব কালক্রমে হালখাতার হিসাব-নিকাশের ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় সর্বজনীন উপলক্ষ হয়ে উঠেছে যেমন, তেমনি ক্রমাগত সাম্প্রদায়িক চেতনার বিরুদ্ধে আজ এক সূত্রে এক প্রতিজ্ঞায় ঐক্যের মহামিলনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত। এর জৌলুস দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এর ঐতিহ্যকে বিশ্বের মাঝে বাঙালি জাতির কৃষ্টি সংস্কৃতির নিজস্বতার এক প্রতীক হয়ে জানান দিয়ে যায়। ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা’– এই মন্ত্রকে ধারণ করে যাবতীয় অকল্যাণকে দূরীভূত করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার মঙ্গলবার্তা ও শুভাকাঙ্ক্ষা নিয়ে প্রতি বছর পহেলা বৈশাখ আমাদের পুনরুজীবিত করে। বাংলা নববর্ষ বাঙালি জাতির কৃষ্টি, সংস্কৃতিকে রক্ষার মহামিলনের বিনিসুতার মালায় ভালোবাসার রাখিবন্ধনে জাতিসত্তার এক প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে আজ।

বাঙালি জাতির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে পহেলা বৈশাখে ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী এবারের চল্লিশতম বর্ষবরণ উৎসব করেছে। আনন্দঘন আয়োজনের মধ্য দিয়ে ঋষিজের শিল্পীরা বৈশাখী গান গণসংগীত পরিবেশন করে। ঋষিজের আয়োজনের ঐতিহ্য আমরা ধরে রাখতে চাই যুগ যুগ ধরে। আমরা বিশ্বাস করি, এর মাধ্যমে বাঙালির চেতনার সমৃদ্ধি ঘটবে এবং ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনে পরিশীলিত সাংস্কৃতিক চর্চার পথ উন্মুক্ত হবে।

সুরাইয়া আলমগীর: সভাপতি, ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী