
২০১৪ সালের কথা। বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান টেকসই উন্নয়নের জন্য ব্যাপক প্রশংসা করেছে শ্রীলঙ্কার। সে সময় ‘শ্রীলঙ্কা ক্যাম্পেইন’ নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘রোডস পেভড উইথ গোল্ড’ বা সোনায় মোড়ানো রাস্তা নামের একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। রিপোর্টটিতে চীন, জাপান ও এডিবির কাছ থেকে বিপুল ঋণ নিয়ে ব্যয়বহুল অবকাঠামো নির্মাণের কর্মযজ্ঞ অর্থনৈতিকভাবে কতটুকু টেকসই– সে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। রিপোর্টটিতে বলা হয়েছিল, শ্রীলঙ্কায় রাস্তা নির্মাণের খরচ বৈশ্বিক গড়ের তুলনায় সাড়ে তিন গুণ এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভারতের তুলনায় ১১ গুণ, যার জন্য সর্বব্যাপী দুর্নীতি দায়ী।
শ্রীলঙ্কার ক্ষমতাসীনরা সে সময় এসব প্রশ্ন কানে তোলেননি। তাঁরা শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির কাঠামোগত সংকটগুলো আড়ালে রেখে ব্যয়বহুল অবকাঠামো নির্মাণ চালিয়ে গেছেন। অবকাঠামো নির্মাণে বিপুল ব্যয় একটা পর্যায়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখলেও পরিণতিতে যখন অর্থনীতির নতুন ঋণ গ্রহণের সক্ষমতা শেষ হয়ে যায় এবং ঋণ পরিশোধের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে ব্যর্থ হয়, তখন সেই প্রবৃদ্ধিও শ্লথ হয়ে যায়। বৈদেশিক ঋণনির্ভর অবকাঠামো প্রকল্প ছাড়াও আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বাণিজ্যিক ঋণ গ্রহণ, নিম্ন কর-জিডিপি অনুপাত, বাজেট ঘাটতি, পর্যটন ও প্রবাসী আয় হ্রাস; সর্বোপরি ব্যাপক দুর্নীতির কারণে শ্রীলঙ্কা চরম অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে। এর খেসারত এখনও সে দেশের জনগণকে দিতে হচ্ছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেক দিক থেকে শ্রীলঙ্কার তুলনায় ভিন্ন। কিন্তু অস্বস্তিকরভাবে, এ দেশেও কিছু অবকাঠামো প্রকল্প বিশ্বের মধ্যে অন্যতম ব্যয়বহুল হিসেবে চিহ্নিত। এখানে প্রতি কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের খরচ প্রতিবেশী ভারত ও চীন তো বটেই; কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইউরোপের তুলনায়ও অধিক।
যেমন চার লেন সড়ক তৈরিতে ভারতে কিলোমিটারপ্রতি ১১ থেকে ১৩ লাখ ডলার, চীনে ১৩ থেকে ১৬ লাখ ডলার এবং ইউরোপে ২৫ থেকে ৩৫ লাখ ডলার খরচ হয়। অন্যদিকে চার লেন সড়ক নির্মাণের জন্য রংপুর-হাটিকুমরুল মহাসড়কে প্রতি কিলোমিটারের জন্য ৬৬ লাখ ডলার, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে ৭০ লাখ, ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কে ১ কোটি ১৯ লাখ, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ২৫ লাখ ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে ২৫ লাখ ডলার খরচ পড়েছে। এই হিসাবে বাংলাদেশের কোনো কোনো সড়ক নির্মাণ খরচ ভারত ও চীনের দ্বিগুণ থেকে ৯ গুণ এবং ইউরোপের সমপরিমাণ থেকে দ্বিগুণ। যদিও আমাদের শ্রমের মূল্য ওইসব দেশের তুলনায় বেশ কম।
বাংলাদেশের বাস র্যাপিড ট্রানজিট-বিআরটি প্রকল্পও বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল তকমা পেয়েছে। বিদ্যমান রাস্তার ওপর নির্মাণ করা হয় বলে বিআরটি নির্মাণের খরচ ও সময় দুটোই কম লাগে। বিশ্বে বিআরটি নির্মাণের খরচ কিলোমিটারপ্রতি সর্বোচ্চ ৬ মিলিয়ন ডলার হলেও বাংলাদেশে পড়ছে ২৬ মিলিয়ন ডলার! গাজীপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত ২০ দশমিক ৫ কিলোমিটার বিআরটি লাইন প্রকল্পটি ২০১২ সালে যখন হাতে নেওয়া হয়েছিল, তখন খরচ ধরা হয়েছিল ২ হাজার ৪০ কোটি টাকা, যা ইতোমধ্যে দ্বিগুণ বাড়িয়ে ৪ হাজার ২৬৪ কোটি টাকা করা হয়েছে।
ঢাকায় মেট্রোরেলের নির্মাণ ব্যয়ও সাম্প্রতিক সময়ে নির্মিত অন্যান্য দেশের ব্যয়ের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি পড়েছে। ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তার নর্থ-সাউথ মেট্রোরেল প্রকল্পের প্রথম পর্বের নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৩ সালে এবং সমাপ্ত হয় ২০১৯ সালে। জাইকার ঋণে তৈরি ১৫ দশমিক ২ কিলোমিটার দীর্ঘ এ মেট্রোরেল নির্মাণে খরচ হয় ১০৫ কোটি ডলার, অর্থাৎ প্রতি কিলোমিটারের নির্মাণ ব্যয় ৬ কোটি ৯০ লাখ ডলার। পাকিস্তানের লাহোরের অরেঞ্জ মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৫ সালে, আর শেষ হয় ২০২০-এর অক্টোবরে। চীনের ঋণে তৈরি ২৭ দশমিক ১২ কিলোমিটার দীর্ঘ এই মেট্রোরেল নির্মাণে খরচ হয় ১৬২ দশমিক ৬ কোটি ডলার। অর্থাৎ প্রতি কিলোমিটারে নির্মাণ ব্যয় ৬ কোটি ডলার। অন্যদিকে ঢাকায় উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ২১ দশমিক ২৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের মেট্রোরেল নির্মাণে খরচ পড়ছে ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা বা ৩৩৪ কোটি ৭২ লাখ ডলার (প্রতি ডলার সমান ১০০ টাকা ধরে)। অর্থাৎ কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় ১৫ কোটি ৭৪ লাখ ডলার, যা সাম্প্রতিককালে নির্মিত জার্কাতা ও লাহোর মেট্রোরেলে ব্যয়ের দ্বিগুণেরও বেশি।
যে কোনো বিবেচনাতেই বাংলাদেশের বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয় অস্বাভাবিক বেশি। এই অস্বাভাবিক ব্যয়ের পেছনে অনিয়ম, দুর্নীতি ও প্রকল্প পরিকল্পনার সমস্যার যোগসূত্র রয়েছে। প্রকল্প পরিকল্পনা সঠিকভাবে না করার কারণে অনেক সময় প্রকল্প শুরুর পর নকশায় ত্রুটি ধরা পড়ে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ অংশ পরে যোগ বা সংশোধন করতে হয়। এসব করতে গিয়ে প্রকল্প দীর্ঘায়িত হয় এবং ব্যয় বাড়ে। এ জন্য কাউকে জবাবদিহি করতে হয়েছে বা শাস্তি পেতে হয়েছে– এ রকম শোনা যায় না, যার খেসারত শেষ পর্যন্ত জনগণকেই দিতে হয়।
কোনো প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয় অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেলে জনগণকেই যে নানাভাবে তার খেসারত দিতে হয়; ঢাকায় প্রথম মেট্রোরেলের উচ্চ নির্মাণ ব্যয় ও উচ্চ ভাড়ার হার তারই দৃষ্টান্ত। সমকালে প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে, ২০২১ সালে মেট্রোরেলের ভাড়া নির্ধারণ কমিটি হিসাব দিয়েছিল, এমআরটি-৬-এ দৈনিক খরচ হবে ২ কোটি ৩৩ লাখ ৫ হাজার ৭৪১ টাকা। এর পর মেট্রোরেলের নির্মাণ ব্যয় আরও বৃদ্ধি পাওয়ায় দৈনিক খরচ বেড়ে হয়েছে ৩ কোটি ৩৬ লাখ ৩৩ হাজার টাকা। এ খরচ মেটাতেই মেট্রোরেলের ভাড়া ২০২১ সালের প্রস্তাবিত কিলোমিটারপ্রতি ২ টাকা ৪০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৫ টাকা করা হয়েছে। এভাবে ভাড়ার টাকা থেকে ঋণের কিস্তির খরচ ওঠানোর জন্যই ঢাকার মেট্রোরেলের ভাড়া দিল্লির ভাড়ার দ্বিগুণ, কলকাতার তিন থেকে চার গুণ এবং লাহোরের দুই থেকে পাঁচ গুণ করা হয়েছে।
এভাবে অবকাঠামোগত প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয় বৃদ্ধির কারণে একদিকে টোল, ভাড়া ও বিদ্যুতের মূল্য বাবদ জনগণের বাড়তি অর্থ ব্যয় হয়; বাড়তি নির্মাণ ব্যয় মেটাতে গিয়ে জনগণের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ করের বোঝা বাড়ে। অন্যদিকে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় বৈদেশিক রিজার্ভের ওপরেও চাপ বাড়ে, যা চূড়ান্ত অর্থে দেশের টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।
কল্লোল মোস্তফা: প্রকৌশলী; উন্নয়ন
অর্থনীতিবিষয়ক লেখক
মন্তব্য করুন