এইচএসসি পাস করে ফেনীর সোনাগাজী থেকে বছর দুয়েক আগে রাজধানীতে পা রাখেন মহিব উল্যাহ। পড়ছেন ঢাকা কলেজে। এক বছর শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যায় ভুগে টিকতে না পেরে শেষমেশ যান মহাখালীর জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের বহির্বিভাগে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে চিকিৎসক জানিয়ে দেন– তাঁর অ্যাজমা। এ কথা শুনে ভড়কে যান মহিব উল্যাহ। কারণ, জন্মের পর থেকে তাঁর এমন সমস্যা ছিলই না। তিনি জানান, ঢাকায় আসার পর থেকেই তাঁর শ্বাসজনিত নানা সমস্যা বেড়েছে। তাঁর ধারণা, ধুলাবালুর কারণেই এমনটা হয়েছে। নানা গবেষণাও বলছে– মহিব উল্যাহর ধারণাই সত্য, যা রীতিমতো উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। মহিব উল্যাহর মতো রাজধানীতে এসে অ্যাজমা বা হাঁপানি রোগে হাঁপাচ্ছেন এমন মানুষের সংখ্যা কম নয়।

চিকিৎসকরা বলছেন, গত পাঁচ বছরের চেয়ে এখন অ্যাজমা রোগীর সংখ্যা দুই থেকে তিন গুণ। শুষ্ক মৌসুমে রোগীর চাপ বাড়ে। এর একটি বড় কারণ বায়ুদূষণ। পরিবেশবিদরা বলছেন, দিনের পর দিন অস্বাস্থ্যকর থাকছে রাজধানীর বাতাস। মাঝেমধ্যে বিশ্বের দূষিত নগরের তালিকার শীর্ষে উঠে আসছে ঢাকা। এমনকি কখনও কখনও ঢাকাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে রংপুর-সিলেটের মতো কিছু নগর। তবু এ বিষয়ে সরকারের তোড়জোড় নেই; নেই সতর্কবার্তা। বাতাস নির্মল করার দায়িত্বে থাকা সরকারি সংস্থাগুলোর অবহেলার কারণে এই ভয়ানক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এমন প্রেক্ষাপটে আগামীকাল মঙ্গলবার পালিত হবে বিশ্ব অ্যাজমা বা হাঁপানি দিবস। বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর মে মাসের প্রথম মঙ্গলবার দিবসটি পালন করা হয়। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘সবার জন্য অ্যাজমার যত্ন’।

বিষাক্ত ঢাকার বাতাস

২০১৮ সালের কথা। তখন বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ছিলেন মার্শা বার্নিকাট। তিনি বাংলাদেশে কাজে যোগ দেওয়ার তিন মাসের মধ্যে শ্বাসকষ্টের সমস্যায় পড়েন। বার্নিকাট নিজেই সে সময় গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘এক রাতে আমার ঘুম ভেঙে গেল, নিঃশ্বাস নিতে হাঁসফাঁস হচ্ছিল। তা ছিল অ্যাজমারই লক্ষণ। চিকিৎসকের কাছে গেলে তাঁরা জানান, অ্যাজমা হয়েছে। আর এর কারণ ঢাকার দূষিত বায়ু। এর পর থেকে আমাকে শুষ্ক মৌসুমে নিয়মিত ইনহেলার নিতে হয়।’

পরিবেশবিদরা বলছেন, এতে প্রমাণিত হয়, বায়ুদূষণের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছেন না কেউ। উচ্চবিত্ত থেকে নিম্ন আয়ের মানুষ– সবাই দূষণের শিকার।

সুইজারল্যান্ডের বায়ুদূষণ পর্যবেক্ষক সংস্থা একিউএয়ারের তথ্য বলছে, গেল জানুয়ারিতে এক দিনের জন্যও অস্বাস্থ্যকর অবস্থা থেকে নামেনি ঢাকার বায়ু; বরং ওই মাসের ২৬ দিনই ঢাকা নগরের বাতাস ছিল বিপজ্জনক। এর সঙ্গে যুক্ত হয় বিষাক্ত প্লাস্টিকের কণা। এবার ঈদের ছুটিতে এক দিনও নির্মল বাতাস নিতে পারেনি ঢাকাবাসী। এত বেশি বায়ুদূষণ গত ১৩ ঈদের মধ্যে আর হয়নি বলে জানিয়েছে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)। এভাবে মারাত্মক দূষিত বায়ু নিয়মিত রাজধানীসহ প্রধান শহরগুলোর অধিবাসীদের শরীরে ঢুকছে। দূষণে হঠাৎ মৃত্যু না হলেও তা ধীরে ধীরে রাজধানীবাসীর শরীরে নানা রোগের বাসা বাঁধছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আবদুস সালাম বলেন, ‘আমরা ঢাকা শহরের ১৩টি জায়গা থেকে নমুনা নিয়েছি। সেখানে মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর বিষাক্ত প্লাস্টিক কণার অস্তিত্ব পেয়েছি। প্লাস্টিক পোড়ানোসহ বিভিন্ন কাপড়েও প্লাস্টিকের অস্তিত্ব আছে। সেগুলো থেকেই বায়ুতে এই প্লাস্টিক কণা মিশছে। এগুলো নিঃশ্বাসের সঙ্গে শরীরে প্রবেশ করে।’

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘দূষিত বায়ু বা প্লাস্টিক কণা নিঃশ্বাসের সঙ্গে শরীরে ঢুকলে অ্যাজমাসহ ফুসফুসের নানা রোগ হতে পারে। শ্বাসতন্ত্রের রোগের সঙ্গে ধুলাবালির সরাসরি সম্পর্ক আছে।’

অ্যাজমা রোগী বাড়ছেই

বর্তমানে দেশে অ্যাজমা রোগীর সংখ্যা ১ কোটি ১০ লাখ। প্রতিবছর নতুন করে আনুমানিক ১০ লাখ মানুষ এ রোগের খাতায় নাম লেখাচ্ছে। এর মধ্যে মারা যাচ্ছেন ৪০ হাজার। কয়েক বছরে এ রোগে আক্রান্তদের চিকিৎসা নেওয়ার হার বেড়েছে। তবে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে এখনও ৮০ শতাংশ রোগী আধুনিক চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, শহর এলাকায় অ্যাজমা রোগীর সংখ্যা বেশি। কারণ হিসেবে বায়ুদূষণকে দায়ী করছেন তাঁরা। ঘনবসতি ও কলকারখানার ধোঁয়ার কারণে শহরাঞ্চলের বায়ু বেশি দূষিত থাকে। এ কারণে শহরের মানুষের অ্যাজমায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপ বলছে, দেশে ১৫ কারণে মানুষের বেশি মৃত্যু হচ্ছে। এর মধ্যে অ্যাজমার অবস্থান চতুর্থ। দেশে ১০০ জনের মধ্যে সাতজনের মৃত্যু হচ্ছে অ্যাজমার কারণে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শহরের মানুষ অ্যাজমায় বেশি আক্রান্ত হলেও মৃত্যু বেশি হচ্ছে গ্রামে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে এ রোগের কেনো চিকিৎসাকেন্দ্র না থাকায় সেখানে মৃত্যু বেশি। এ ছাড়া ইটভাটাসহ নানা কারণে সাম্প্রতিক সময়ে গ্রামেও দূষণ বেড়েছে। অ্যাজমা রোগীর চিকিৎসায় রাজধানীর মহাখালী জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের অধীনে উন্নত চিকিৎসায় অ্যাজমার সেন্টার গড়ে তোলা হয়েছে। গত বছর এ সেন্টার থেকে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের মধ্যে ৮ হাজার ৪৮০ জনের অ্যাজমা শনাক্ত হয়। এদের ২৫ শতাংশই শিশু। এ রোগে নারীর চেয়ে আবার পুরুষের আক্রান্তের হার বেশি।

জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মু. সাইদুল ইসলাম সমকালকে বলেন, আগের তুলনায় হাসপাতালে রোগী বেড়েছে। বহির্বিভাগে প্রতিদিন যে পরিমাণ রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন, এর ৩০ শতাংশ হাঁপানির রোগী।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. এ কে এম মোশাররফ হোসেন বলেন, এটি জন্মগত রোগ, এ রোগ বেশি দেখা দিচ্ছে শহরকেন্দ্রিক। অল্প বয়সেই প্রথমে দেখা দেয়। বয়সের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে। তবে নিয়ন্ত্রিত জীবনের মাধ্যমে হাঁপানি রোগ থেকে ভালো থাকা যায়। হাঁপানি নিয়ন্ত্রণে পরিবেশ দূষণের বিষয়ে সরকারকে ভাবার পাশাপাশি স্বাস্থ্যশিক্ষা ও সচেতনতা কার্যক্রম চালানোর ওপর জোর দেন এ বিশেষজ্ঞ।

ডেঙ্গু ও করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণের মতো এ রোগ ঠেকাতে সরকারের আলাদা কোনো কর্মসূচি নেই। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের (সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ) শাখা এ নিয়ে কাজ করে। অধিদপ্তরের সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. রুবেদ আমিন সমকালকে বলেন, অ্যাজমা নিয়ন্ত্রণে সরকার কাজ করছে। বিভিন্ন জেলায় শ্বাসকষ্ট উপশমে ব্যবহৃত ইনহেলার বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে।

ক্যাপসের পরিচালক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, শ্বাসযন্ত্রের রোগ প্রতিরোধে এখন একটিই উপায় তা হলো, দূষণ উপকরণ কমানো। বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে গত আট বছরে উচ্চ আদালত ১১টি নির্দেশনা দিয়েছেন। তবে এর বাস্তবায়ন নেই। যেদিন বায়ুমান খারাপ থাকবে, সেদিন রেডিও-টেলিভিশনে তা প্রচার করতে হবে। শিশু ও বয়স্করা খুব বেশি প্রয়োজন না হলে বাইরে যাবে না। বাইরে যেতে হলে মাস্ক পরতে হবে। যাঁরা শ্বাসতন্ত্রের সমস্যায় ভুগছেন, তাঁদের জন্য এই সংকেত অনেক উপকারী হবে।

রাজধানীর বায়ুমান নিয়ে একাধিক উদ্যোগ নেওয়ার পরও কেন এখনও দূষিত নগরের তালিকায় শীর্ষে থাকছে ঢাকা, তা জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের বায়ুমান ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিচালক মো. জিয়াউল হক বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি বায়ুদূষণের প্রধান উৎসগুলো নিয়ন্ত্রণের। তবে আমাদের উদ্যোগ থাকলেও সিটি করপোরেশন, ট্রাফিক বিভাগসহ অন্য সংস্থাগুলোর সহযোগিতা পাওয়া যায় না। কেউ আমাদের কথা শোনে না।’