নারীর প্রজনন এবং মাতৃস্বাস্থ্য নিয়ে সম্প্রতি যৌথভাবে গবেষণা চালিয়েছে দুটি সংস্থা। এতে দেখা গেছে, পোশাক শ্রমিকদের মধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের হার ৪৩ শতাংশ। এ অবস্থা আরও উদ্বেগজনক শিশু ও কিশোরীদের মধ্যে। এসব ঘটছে বাল্যবিয়ে, অনিয়মিত গর্ভনিরোধক ব্যবহার, গর্ভনিরোধক ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনুভূত, শ্বশুরবাড়িতে বিবাহিত তরুণীদের প্রতিনিধিত্বের অভাব, সন্তানের মাধ্যমে দাম্পত্য সম্পর্ককে দৃঢ় করার ইচ্ছা, পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাবসহ বিভিন্ন কারণে।

বুধবার রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে ‘ন্যাশনাল কনফারেন্স ২০২৩: সেক্সুয়াল অ্যান্ড রিপ্রোডাকটিভ হেলথ অ্যান্ড রাইটস’ বিষয়ক সম্মেলনে এ-সংক্রান্ত চারটি গবেষণাপত্র উপস্থাপন করা হয়। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর’বি) ও অ্যাডভানসিং সেক্সুয়াল অ্যান্ড রিপ্রোডাকটিভ হেলথ অ্যান্ড রাইটসের (অ্যাডসার্চ) যৌথভাবে পরিচালিত এক গবেষণার ফলাফলে পোশাক শ্রমিকদের প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হয়।

নিবন্ধটি উপস্থাপন করেন আইসিডিডিআর’বির গবেষক তাশফিয়া নুসরাত রুহি। তিনি জানান, ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে বসবাস করা নারী পোশাক শ্রমিকদের মধ্যে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের হার কেমন তা দেখতে এ গবেষণা করা হয়। গত বছরের আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত টঙ্গী, রাজধানীর মিরপুর ও কড়াইল বস্তির ৬৫৬ জন বিবাহিত পোশাক শ্রমিকের ওপর জরিপ চালানো হয়। এ ছাড়া বিবাহিত পোশাক শ্রমিকের স্বামী, চিকিৎসক, এনজিও কর্মী, ট্রেড ইউনিয়ন কর্মী, ওষুধের দোকানদারের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। এটি এই গবেষণার প্রথম পর্ব। তিন পর্বের এ গবেষণার দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্ব হবে যথাক্রমে আগামী বছর এবং পরের বছর। প্রথম পর্বের গবেষণায় উদ্বেগজনক অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের পেছনে তিনটি কারণ পাওয়া গেছে। এগুলো হচ্ছে– জন্মনিয়ন্ত্রণ উপকরণ নিয়মিত ব্যবহার না করা, মাঝপথে এসব উপকরণ ব্যবহার ছেড়ে দেওয়া। জন্মনিয়ন্ত্রণের বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকা।

তাশফিহা নুসরাত বলেন, আমরা দেখেছি, নারী পোশাক শ্রমিকরা জন্মনিয়ন্ত্রণের বিষয়ে স্বামীর সঙ্গে আলোচনা করেন না এবং তাদের কর্ম পরিবেশও চ্যালেঞ্জিং। তারা বলেছেন, তাদের দীর্ঘসময় ধরে কাজ করতে হয়, অনেকের স্বামীও তাদের সঙ্গে পোশাক কারখানায় কাজ করেন। তাই নিয়মিত জন্মনিয়ন্ত্রণ উপকরণ সংগ্রহ ও ব্যবহার করতে পারেন না তাঁরা। একই কারণে পুরুষরাও সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিতে পারেন না। জন্মনিয়ন্ত্রণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রেও নারীর অবদান অনেক কম।

কারখানায় নারীকর্মীদের মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণ উপকরণের সহজলভ্যতা বাড়ানো ও প্রজনন স্বাস্থ্যের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে নারীদের পছন্দকেও গুরুত্ব দিতে পুরুষ সঙ্গীদের উদ্বুদ্ধ করা প্রয়োজন বলে সুপারিশ করেন গবেষকরা। তাঁরা বলছেন, গর্ভধারণসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত মেয়েদের নিজেদের নিতে হবে। প্রজনন শিক্ষায় পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি শিক্ষক, স্বাস্থ্যকর্মী ও ধর্মীয় নেতাদের ভূমিকা রাখতে হবে।

একই সংস্থার অপর এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে আগের তুলনায় অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভপাত কমেছে। ২০১৪ সালে দেশে এই হার ছিল ৬ দশমিক ৪ শতাংশ, ২০১৭-১৮ সালে তা কমে ৫ দশমিক ২ শতাংশ নেমেছে। পাশাপাশি গর্ভপাতের ক্ষেত্রে ধনী ও দরিদ্র নারীদের পার্থক্য কমেছে। ২০১১ সালে ধনী প্রতি চার নারীর বিপরীতে দরিদ্র একজন নারী এ কাজ করতেন। এখন সে হার কমে দুইজন ধনী নারীর বিপরীতে একজন হয়েছে।

সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্বাস্থ্য সচিব ড. মুহাম্মদ আনোয়ার হোসেন হাওলাদার বলেন, যৌন এবং প্রজনন স্বাস্থ্য মানুষের ব্যক্তিগত অধিকার। আমাদের হাসপাতাল এবং সব প্রতিষ্ঠানে সে ধরনের পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যেন যেখানে গেলে নারীরা স্বস্তিবোধ করেন। এমন যেন না হয়, সেখানে গেলে তাঁরা অহেতুক হয়রানির শিকার হন।

অনুষ্ঠানে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং অধিকার বিষয়ে উদ্ভাবন নিয়ে দুটি পৃথক বৈজ্ঞানিক সেশন আয়োজন করা হয়। সম্মেলনে বিশেষজ্ঞরা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাঁদের তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরেন। গবেষণা ও উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করার জন্য সম্মেলনের আগে গবেষণা ধারণাপত্র ও উদ্ভাবনী প্রস্তাবনা আহ্বান করা হয়। সেখান থেকে বাছাই করা সেরা গবেষণা ধারণাপত্র ও উদ্ভাবনী প্রস্তাবনাগুলো উপস্থাপন করা হয় এবং সেরাদের পুরস্কার দেওয়া হয়।