
পঞ্চাশ পাখির গল্প, লেখক-মানজুর মুহাম্মদ, প্রকাশক-কথাপ্রকাশ, প্রচ্ছদ-সোহাগ পারভেজ, দাম-১২০০ টাকা
পাখি ছাড়া প্রকৃতির কথা চিন্তাও করা যায় না। একইভাবে প্রকৃতি ছাড়া মানুষের কথাও ভাবা প্রায় অসম্ভব। এ যেন অবিচ্ছেদ্য এক সত্তা! নদী, পাহাড়, বন আর সমতলের বৈচিত্র্যে ভরা বাংলাদেশের সবুজ-শ্যামল নিসর্গে সর্বত্রই পাখপাখালির রাজত্ব। আবার শীতে এখানকার জলাশয়গুলো ভরে ওঠে পরিযায়ী পাখির কলকাকলিতে। দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা এই বিচিত্র সব পাখি আমাদের প্রকৃতির মূল জীবনীশক্তি। সেই পাখিদের পঞ্চাশটি রূপময় জগৎ উঠে এসেছে মানজুর মুহাম্মদের ‘পঞ্চাশ পাখির গল্প’ শীর্ষক গ্রন্থে। গল্পগুলো কিশোর-উপযোগী হলেও পরিণত পাঠকের ভাবাবেগ এবং মননকেও উজ্জীবিত করতে পারে। এর ভাষার সারল্যও পাঠককে আনন্দ দেবে। গল্পের মাঝেও রয়েছে বৈচিত্র্য।
বাংলাদেশ পাখির দেশ। গানের দেশ। ফুল-প্রজাপতির দেশ। এখানে প্রায় ৭০০ প্রজাতির পাখি আছে। এর অর্ধেক অতিথি পাখি। তারা আমাদের দেশে আসে বছরের বিশেষ সময়ে। কিছুদিন থেকে আবার চলে যায়। বাকি অর্ধেক আবাসিক। বাংলাদেশের পাখির নামও খুব আদুরে। যেমন– ফুটফুটি, বসন্তবৌরি, ফুলঝুরি, ভরত, চশমা পাখি, নীলকণ্ঠ, মুনিয়া, সহেলি, হলদেবউ, কমলাবউ, বন্ধন, নীলপরী, শ্যামা, দোয়েল, বুলবুলি, চড়ুই, মথুরা, রঙিলা বক, ডুবুরি, পাপিয়া, রাঙ্গাহালতি, হালতি ইত্যাদি। নামগুলো মন ছুঁয়ে যায়। এদের কণ্ঠ সুরেলা। তাদের গানে প্রাণ ভরে যায়। সবচেয়ে ছোট্ট পাখিটির নাম ফুলঝুরি, আর সবচেয়ে বড়টির নাম মদনটাক। পাখিরা আমাদের পরিবেশের এক বড় সম্পদ। তারা শুধু সৌন্দর্যই বৃদ্ধি করে না, বনের খাদ্যশৃঙ্খলে স্বাভাবিক ধারাও বজায় রাখে। পাখিরা ফসলের যতটুকু খায়, ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ খেয়ে উপকার করে এর চেয়ে বেশি। তারা উদ্ভিদের পরাগায়ন ও বীজের বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
এই পাখিদেরও আছে মন। আছে আবেগ, অনুভব ও উপলব্ধি। তারাও ভালোবেসে বন্ধুর সঙ্গে ঘর বাঁধে। তাদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, স্নেহ, মায়া, মমতা, ভালোবাসা, ক্রোধ, বিদ্রোহ এবং বীরত্বগাথা নিয়ে রচিত ‘পঞ্চাশ পাখির গল্প’। ‘স্বর্গীয় পাখি দুধরাজ’ গল্পে পাখির দুর্দান্ত বর্ণনা দিয়েছেন লেখক– ‘ওর মাথায় আছে এক চমৎকার রাজকীয় কালো রঙের চূড়ো। মনে হচ্ছে ও চকচকে কালো পালকের কোনো মুকুট পরেছে। ওর ঠোঁটের রং নীল। সেই তীক্ষ্ম কপাল কী সুন্দর কালো। ঘাড়ের ওপরের কালো চুলগুলো যেন কোনো পার্লারে গিয়ে সমান করে কেটে নিয়ে ব্যাকব্রাশ করেছে। ওর বুক আর পেট তুলোর মতো শুভ্র। গলা ও কপাল কী সুন্দর কালো। নীল রঙের চোখের মণিতে সূক্ষ্ম একটি সাদা অনন্যসুন্দর বিন্দু আছে। পায়ের রং হালকা লাল। ওর লেজের সৌন্দর্য দেখে যে কেউই মুগ্ধ হবে। ওর লম্বা লেজটি শরীরের তুলনায় তিন ভাগের দুই ভাগ। লেজের অগ্রভাগ থেকে দুটি লখ সাদা পালক ফিতার মতো নেমে গেছে। ওই সাদা পালক দুটির রূপ-মাধুর্য ও শারীরিক অপার সৌন্দর্যে ওকে স্বর্গীয় পাখি বলে মনে হয়। বাদামি কানের তুলতুলে খরগোশছানারা আর ছোট পাখিগুলো খেলা ভুলে এই অনন্যসুন্দর পাখিটির উড়ন্ত সৌন্দর্য মুগ্ধ হয়ে দেখছে। পাখিটি ওদের ওপর ঘুরে ঘুরে উড়ছে। সে যেন উড়ে উড়ে বলছে, এই দেখ আমি কত সুন্দর। আমার লেজের পালক কত চমৎকার। ও যখন বাতাসের বিপরীতে উড়ছে তখন ওর লেজের সাদা ফিতা দুটি টানটান হয়ে যাচ্ছে। তাকে তখন আরও সুন্দর লাগছে। আর যখন বাতাসের অনুকূলে উড়ছে তখন ওই ফিতা দুটি তার মাথার ওপরে উল্টে এসে পড়ছে। তখনও তাকে অন্যরকম সুন্দর লাগছে। সে কিছুক্ষণ উড়ে একটি গাছের ডালে বসল। বসার পর তার লেজের পেছনের লম্বা সাদা ফিতা দুটি তরবারির মতো বাঁকা হয়ে নিচের দিকে ঝুলে থাকল। হঠাৎ দমকা বাতাস এসে ওর দুধের মতো সাদা লেজের মসৃণ মোলায়েম ফিতা দুটি নাচিয়ে দিল। এমন দৃশ্য দেখে খরগোশ ছানা ও ছোট ছোট পাখি হাততালি দিল। হাততালি শুনে অনিন্দ্যসুন্দর পাখিটি হেসে দিল। পাখিটির নাম হলো দুধরাজ।’ পাখির সৌন্দর্যের এমন প্রাঞ্জল ব্যাখ্যা তরুণ পাঠকদের প্রকৃতির আরও কাছে টানবে।
‘পলাশি নদীর পানি লাল। সিরুর বাবা বলল– মজু ভাই এই রক্তের ওপর দিয়া কীভাবে নৌকা চালাব। এই রক্ত তো আমার তোমার বাবা, ভাই, বোনের, সন্তানের। পাকিস্তানিরা আমাদের এমন করে কচুকাটা করছে যে, নদীর পানি তো আর পানি থাকল না, সব রক্ত হয়ে গেছে। মজু মিঞা ধমক দিয়ে বলল, বেশি কথা বলিস না, নৌকায় ওঠ। সিরুর বাবা হাউমাউ করে কেঁদে বলল– আমি পারব না, আমি রক্তের ওপর নৌকা বাইতে পারব না। আমি তোমাকে আগেও বলেছি, আমি পারব না। মজু মিঞা পাকিস্তানিদের কানে কানে কী যেন বলল। অমনি পাকিস্তানি সৈন্য দু’জন সিরুর বাবাকে পায়ের বুট দিয়ে একের পর এক লাথি মারতে লাগল। সিরুর বাবা মাটিতে পড়ে গেল। সিরু কড়ইগাছের ওপর থেকে সব দেখছে। সে রাগে-ক্ষোভে ফেটে পড়ছে। সিরুর বাবার বুকের ওপর বুট দিয়ে উপর্যুপরি আঘাত করে করে পাকিস্তানি সৈন্য দু’জন বলছে, হারামজাদা, কিশতি চালাও ... কিশতি চালাও। সিরুর বাবার নাকে-মুখে রক্ত ঝরছে। সিরুর বাবা চিৎকার করে বলতে লাগল– আমার ভাইয়ের রক্তের ওপর দিয়ে আমি নৌকা চালাতে পারব না, কোনোদিন পারব না। সিরু মধুকে বলল– এক্ষুনি গিয়ে ওই পাকিস্তানি দু’জনের চোখ তুলে নে। মধু তৎক্ষণাৎ কড়ইগাছ থেকে জেট বিমানের মতো উড়ে গিয়ে এক পাকিস্তানির চোখে তার তীক্ষ্ম নখর গেঁথে দিল। পাকিস্তানি যন্ত্রণায় চিৎকার দিয়ে বলতে লাগল– মর গিয়া ... মর গিয়া। মধু শূন্যে ডিগবাজি খেয়ে বিশেষ কৌশলে অন্য সৈন্যের চোখ ও নাকে আক্রমণ করল। আক্রান্ত সৈন্য দু’জন যন্ত্রণায় চিৎকার করছে। মজু মিঞা অবস্থা বেগতিক দেখে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ল।’ ‘মধুপাগল মধুরাজ’ গল্পে পাকিস্তানি বাহিনীর আগ্রাসনের বিপরীতে প্রকৃতির প্রতিরোধেরই চিত্র উঠে এসেছে। যেখানে সিরুর পাখি বন্ধু মধু হানাদার বাহিনীকে আক্রমণ করে। u
মন্তব্য করুন