
কথাসাহিত্যে স্বতন্ত্র স্বর শহীদুল জহির ও অন্যান্য, লেখক-লোকমান কবীর, প্রকাশক- সুচয়নী পাবলিশার্স, প্রচ্ছদ-মোস্তাফিজ কারিগর, দাম-২৪০ টাকা
ঔপন্যাসিক প্রতিভা বসুর ভাষায়, ‘বই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ আত্মীয়, যার সঙ্গে কোনোদিন ঝগড়া হয় না, কোনোদিন মনোমালিন্য হয় না।’ কথাটির ভেতর লুকিয়ে রয়েছে মেধা ও মনন চর্চার উৎকৃষ্ট পন্থা। কথার বিপরীতে কথা, যুক্তির বিপক্ষে যুক্তি খণ্ডনে বই আমাদের পরম আত্মীয়।
ভাষার শৈল্পিকতা, শব্দ বুননের কারুকার্য, বাক্য গাঁথুনির নান্দনিকতা এবং ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির চিত্রপট একটি গ্রন্থের অপরিহার্য উপাদান। লোকমান কবীরের ‘কথাসাহিত্যে স্বতন্ত্র স্বর : শহীদুল জহির ও অন্যান্য’ গ্রন্থটিতে সাতটি প্রবন্ধ সাতজন কথাকারের ভাষার বা গল্পের স্বাতন্ত্র্য সম্পর্কে উপস্থাপন করা হয়েছে।
একজন সৃজনশীল সাহিত্যিকের সবচেয়ে বড় শক্তি শিল্পের স্বাতন্ত্র বিনির্মাণ। এই গ্রন্থটিতে বিনির্মাণকারী লেখক ও বিনির্মিত সাহিত্য সম্পর্কে উপস্থাপন করেছেন। ‘কায়েস আহমেদ, মঞ্জু সরকার ও শহীদুল জহিরের ছোটগল্প: মুক্তিযুদ্ধের বাস্তবতা’ প্রবন্ধ দিয়ে গ্রন্থটি শুরু। মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংসতা, বর্বরতার বলি হন বাংলাদেশের মানুষ। সেই নৃশংসতার বর্ণনা উঠে এসেছে তাঁদের কলমে। গল্পের মাধ্যমে বাস্তবতার নিপুণ প্রকাশ ঘটিয়েছেন তাঁরা। প্রবন্ধে তার মাত্রা চিহ্নিত।
কায়েস আহমেদের ‘যাত্রা’ গল্পটিতে প্রতীকী ও পরাবাস্তব আবহে রচিত। গল্পটিতে মুক্তিযুদ্ধকালীন সেই সময় উপস্থাপিত না হলেও ক্যানভাসটা স্মৃতির। মঞ্জু সরকার ও শহীদুল জহিরের গল্পের কথামালা ও কাহিনি সংক্ষেপণ এখানে উল্লিখিত হয়েছে সময়ের চিত্রপট বর্ণনার স্বার্থে।
‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বেতালপঞ্চবিংশতি : ফিরে দেখা’ প্রবন্ধটিতে বাংলার গদ্যের বিকাশ ও নতুন বিনির্মাণের কথা বর্ণিত। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রথম প্রকাশিত গদ্যসাহিত্য ‘বেতালপঞ্চবিংশতি’ ‘বৈতাল পচ্চিশি’ হিন্দি গ্রন্থ অবলম্বনে রচিত। গ্রন্থটি শিল্পের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা এখানে আলোচিত। ‘বেতালপঞ্চবিংশতি’ গ্রন্থটির দশম সংস্করণের বিজ্ঞাপন থেকে যে বিতর্ক জানা যায়, তা হলো যোগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর শ্বশুর মদনমোহন তর্কালঙ্কারের যে জীবনীগ্রন্থ রচনা করেছেন, সেখানে তর্কালঙ্কারকে বেতালপঞ্চবিংশতির সহরচয়িতা হিসেবে দাবি করেছিলেন। যদিও তা অসত্য বলে জানান করেন বিদ্যাসাগর। এসমস্তের বিবরণ খণ্ড খণ্ড অংশে লেখক সাজিয়েছেন। প্রতিটি প্রবন্ধই অসংখ্য তথ্য সম্বলিত।
‘পুতুল নাচের ইতিকথা : শশীর সংকট ও গতিপথ’ প্রবন্ধে লেখক অসাধারণভাবে রূপায়ণ করেছেন। গ্রাম থেকে উঠে আসা শশী, শহরে গিয়ে ডাক্তার হন, কিন্তু গ্রামকে ভালোবাসতে পারেন না। শহুরে জীবন যেন তাকে আঁকড়ে ধরে। বাস্তব জীবনে শহর ও গ্রামের যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়, শশী তখন দ্বিধায় ভোগেন। বিশ শতকের শিক্ষিত মধ্যবিত্তের যে সংকোচ ও দ্বিধা তা শিল্পে রূপ পেয়েছে। প্রবন্ধটি তার সপ্রমাণ উপস্থাপন।
‘ক্রীতদাসের হাসি হারুনর রশীদ: পুনর্বিচার’ প্রবন্ধে লেখক উপন্যাসের বর্ণনার পাশাপাশি, উপন্যাসটির লেখার উদ্দেশ্য নিয়েও আলোচনা করেছেন। সে সময় আইয়ুব সরকারের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে হারুনর রশীদকে স্বৈরশাসক হিসেবে রূপায়িত করেছেন। শক্তিমান লেখক শওকত ওসমান ‘ক্রীতদাসের হাসি’ উপন্যাসটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে লেখেন। তা যথাযথভাবে উপস্থাপন করেছেন এই প্রবন্ধে।
‘আবদুল মান্নান সরকারের দুই দিগন্তের যাত্রী : প্রান্তিক মানুষের মৃত্তিকা ও দিগন্তের কথকতা’ প্রবন্ধে লেখক আব্দুল মান্নান সরকারের দশটি গল্প নিয়ে আলোচনা করেছেন। যেখানে উঠে এসেছে রাজাকার ও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক শক্তির উত্থান, বাস্তব জীবনের করুণ ঘটনা, মৌলবাদ, শৈল্পিক দলিলসহ গল্পের ক্যানভাসে অনেক রকমের আলোচনা। প্রতিটি গল্পে আবদুল মান্নান সরকার কীভাবে শিল্পশৈলীতে স্বাতন্ত্রতা সৃষ্টি করেছেন। প্রবন্ধে তার রূপ বর্ণিত।
শহীদুল জহিরের ছোটগল্পে বিষয়বাস্তবতা এবং শহীদুল জহিরের ছোটগল্প : নির্মিত-প্রকৌশল— দুটি প্রবন্ধে নানামাত্রিক প্রসঙ্গ উপস্থাপিত। বিষয়বাস্তবতা পছন্দে বাংলা সাহিত্যে শহীদুল জহিরের মতো গল্পকার সীমিত। নিম্নবর্গের আখ্যান, মুক্তিযুদ্ধ, সাম্প্রদায়িকতা, দেশদ্রোহী-বিরোধিতা চেতনা, নারীজীবন, বঞ্চিত মানুষের বিপন্ন জীবন বাস্তবতা, সমাজ ও রাজনীতি, জীবনের একঘেয়ে রূপ, তার সঙ্গে সমসুর আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটসহ বিভিন্ন বিষয়ক গল্প এই প্রবন্ধে বিষয়বস্তু। তাছাড়া ছোটগল্প প্লট নির্মাণে শহীদুল জহিরের ভাষার নান্দনিকতা, চিত্রায়ণ, গল্প বর্ণন কৌশলরীতি, বিভিন্ন ভাষার সংমিশ্রণ বর্ণন উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রবন্ধগুলোয় আরো খানিকটা গিন্নিপনা প্রয়োজন বলে মনে হয়েছে। যদি গল্পের জায়গাগুলো উপশিরোনাম ব্যবহৃত হতো, পৃথক প্রসঙ্গগুলো যদি আরো বিভাজিত ও স্পষ্ট হতো, পাঠের আনন্দ আরো বেড়ে যেত বলে মনে করি।
মন্তব্য করুন