সৌন্দর্যের লীলাভূমি, সবুজেঘেরা পাহাড়ি অঞ্চলে নতুন আতঙ্কের নাম হয়ে উঠেছে কুকিচিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)। পার্বত্য অঞ্চলের ৯টি উপজেলায় স্বায়ত্তশাসন চাওয়া সশস্ত্র সংগঠনটি একের পর এক হত্যা, হামলা, অপহরণ, চাঁদাবাজির মতো অপরাধ করে চলেছে। গত মঙ্গলবার বান্দরবানের রুমায় অভিযানে গিয়ে গুলি ও আইইডি বিস্ফোরণে দুই সেনাসদস্য নিহত এবং দুই সেনা কর্মকর্তা আহত হন। কেএনএফের সশস্ত্র শাখা কুকিচিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ) এ হামলা চালায়। এর আগে বিভিন্ন সময় তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে আতঙ্কিত হয়ে বাড়িঘর ছেড়েছেন পাহাড়ের বাসিন্দারা। এবারের ঘটনার পর আবার আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।

র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন সমকালকে জানান, কেএনএফের প্রধান নাথান বমকে অনেক দিন ধরে খুঁজছেন তাঁরা। তিনি পাঁচ-ছয়টি মামলার আসামি। নাথানসহ সংগঠনের সামরিক ও গণমাধ্যম শাখার প্রধানকে ধরা গেলে প্রয়োজনীয় অনেক তথ্য পাওয়া যাবে। কারা, কীভাবে এ সংগঠনকে ইন্ধন দিচ্ছেন, তাঁরা দেশের ভেতরে না বাইরে অবস্থান করছেন– এসব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নেরও উত্তর মিলবে। তাঁদের কারণে নিরীহ বম জনগোষ্ঠীসহ পাহাড়ের অন্য বাসিন্দাদের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। কেএনএফ পার্বত্য অঞ্চলে জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়াকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। তাদের গোপন আস্তানায় থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে।

কেএনএফকে পার্বত্য অঞ্চলের একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন মনে করা হলেও তাদের দাবি, রাঙামাটির বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি, বিলাইছড়ি এবং বান্দরবানের রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি, লামা ও আলীকদম উপজেলা নিয়ে আলাদা রাজ্য এবং স্বায়ত্তশাসন চায় কেএনএফ। তারা দেশের পার্বত্য অঞ্চলের ছয়টি জাতিগোষ্ঠীর (বম, পাংখোয়া, লুসাই, খিয়াং, ম্রো ও খুমি) প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠন বলেও পরিচয় দেয়। সংগঠনের সভাপতি নাথান বমের বাড়ি রুমার এডেনপাড়ায়। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা থেকে স্নাতক শেষে এডেনপাড়ায় কুকি-চিন ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (কেএনডিও) নামে একটি এনজিও প্রতিষ্ঠা করেন। বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে কেএনএফের নাম আসার পর থেকে নাথানের সঠিক অবস্থান জানা যাচ্ছে না। তবে সূত্র বলছে, বেশিরভাগ সময় তিনি মিজোরাম বা মিজোরাম সীমান্তের দুর্গম এলাকায় থাকেন।

ফেসবুক পেজে তৎপরতা জানায় কেএনএফ। সেখানকার তথ্য অনুযায়ী, সশস্ত্র শাখা কেএনএ ছাড়াও তাদের আরও কয়েকটি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন রয়েছে। এর মধ্যে সহযোগী সংগঠন কেএনডিও এবং অঙ্গ সংগঠন কেএনএম ও কেএসইউ। কেএনএ কমান্ডোদের ‘হেড হান্টার’ ও ‘স্নেক ইটার’ নামে দু’টি গ্রুপ আছে। একজন ক্ষুধার্ত স্নেক ইটার কমান্ডো অভিযানে গিয়ে জীবন্ত সাপ খাচ্ছেন– এমন ভিডিও পেজে দেওয়া হয়েছে। পোস্টগুলোয় বিভিন্ন শাখার কয়েকজনের নাম দেখা যায়। এর মধ্যে রয়েছে– কেএনএফ গোয়েন্দা শাখার লেফটেন্যান্ট কর্নেল সলোমন, লেফটেন্যান্ট পাপুই, লেফটেন্যান্ট সিয়ামা, লেফটেন্যান্ট পাদিক, কেএনএর স্নেক ইটার গ্রুপের করপোরাল লমা, ক্যাপ্টেন মুনলিয়ান, লেফটেন্যান্ট এস চুঙ্গা ও করপোরাল জেএস ম্রো।

সূত্র জানায়, কেএনএফের বর্তমান সদস্য ও অস্ত্রশস্ত্রের পরিমাণ কত, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে প্রথম ব্যাচেই তারা শতাধিক সদস্যকে ভারত ও মিয়ানমারে গোপনে প্রশিক্ষণ দেওয়ার দাবি করে। ২০১৯ সালে প্রশিক্ষিত ওই দলটি এলাকায় ফিরে আসে। এরপর কয়েক দফায় আরও তিন হাজার সদস্যকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ২০১৬ সালে তারা সশস্ত্র শাখা কেএনএ তৈরি করে। তাদের কাছে বেশ কিছু প্রাণঘাতী অস্ত্র রয়েছে। যদিও গোয়েন্দাদের ধারণা, নিজেদের শক্তিমত্তার বিজ্ঞাপন দিতে সংখ্যাকে বহুগুণ বাড়িয়ে বলেছে তারা।

এদিকে, ২০০৮ সালে কেএনএফ প্রতিষ্ঠা হলেও তেমন আলোচনায় ছিল না। তারা নিজেদের পার্বত্য চট্টগ্রামের আদি বাসিন্দা; বিপরীতে চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীকে বার্মিজ এবং ভারতীয় জাতিভুক্তদের বহিরাগত মনে করে। এ কারণে পাহাড়ের সশস্ত্র গোষ্ঠী জেএসএস ও ইউপিডিএফকে পছন্দ করে না। বিভিন্ন সময়ে তাদের মধ্যে সংঘাতের খবরও এসেছে।

র‍্যাব সূত্র জানায়, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নিখোঁজ তরুণদের সন্ধানে নেমে নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসারের সন্ধান পায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ সংগঠনের উগ্রপন্থিদের আইনের আওতায় আনতে গিয়ে কেএনএফের সংশ্লিষ্টতা বেরিয়ে আসে। ২০২১ সালে কেএনএফের প্রতিষ্ঠাতা নাথান বমের সঙ্গে জামাতুল আনসারের আমিরের সমঝোতা হয়। সে অনুযায়ী পার্বত্য অঞ্চলে কেএনএফের ছত্রছায়ায় ২০২৩ সাল পর্যন্ত জঙ্গিদের প্রশিক্ষণের চুক্তি হয়। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী প্রতি মাসে ৩ লাখ টাকা দেওয়ার পাশাপাশি কেএনএফ সদস্যদের খাবার খরচ দিত জামাতুল আনসার। র‍্যাবের অভিযানে কেএনএফের বেশ কয়েকজন ধরাও পড়ে।

গত মঙ্গলবারের আগে ৬ এপ্রিল সন্ধ্যায় বান্দরবানের রোয়াংছড়িতে দুই পক্ষের গোলাগুলিতে আটজন নিহত হয়। কেএনএফ ও ইউপিডিএফের মধ্যে ওই সংঘাত হয় বলে জানা যায়। নিহতদের সাতজনই কেএনএফ সদস্য। আর চলতি বছরের ২৮ জানুয়ারি বান্দরবানের রুমায় কেএনএফের এক সদস্যের লাশ এবং অস্ত্রগুলিসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।