বছর বছর ফেরত যাচ্ছে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ

তবিবুর রহমান
প্রকাশ: ২০ মে ২০২৩ | ১৮:০০
বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে প্রয়োজনের চেয়ে এমনিতেই বরাদ্দ থাকে কম। তবু বছর বছর যে বরাদ্দ মিলছে, তাও শেষ করতে পারছে না স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। প্রতি অর্থবছর বরাদ্দের বড় একটি অংশ ফিরিয়ে দেওয়া যেন রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। এই অর্থবছরের (২০২২-২৩) বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ছিল ৫ দশমিক ৪ শতাংশ; টাকার অঙ্কে তা ৯ হাজার ৭৯৪ কোটি। এর মধ্যে অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে ৩ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা খরচ হয়েছে, যা মোট বরাদ্দের ৩৩ শতাংশ। সে হিসাবে এখনও ৬ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা অলস পড়ে আছে।
শুধু বাজেটের টাকা নয়, বিদেশি সহায়তার ৬৯ শতাংশ অর্থও ব্যয় করা যায়নি। এ ছাড়া স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব বরাদ্দ ১৩ কোটি টাকায় হাত দিতে হয়নি এখনও। এমন পটভূমিতে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ কমতে পারে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
উন্নয়ন প্রকল্প (এডিপি) বাস্তবায়নে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সক্ষমতার অভাবেই এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, কর্মসূচি বাস্তবায়নকারী ব্যক্তিদের দক্ষতা কম। যে বরাদ্দ পান, তার পুরোটা কোনো বছরই খরচ করতে পারেন না। পরিস্থিতি বদলাতে নেই কোনো কর্মপরিকল্পনা। এই খাত চলছে গৎবাঁধা চিন্তায়।
আগের অর্থবছরের (২০২১-২২) বাজেটে বরাদ্দ ছিল ১৩ হাজার ১৭ কোটি টাকা। খরচ হয়েছিল ১০ হাজার ২৯২ কোটি টাকা। সেই অর্থবছরে স্বাস্থ্য বিভাগকে ২৯ শতাংশ টাকা ফেরত দিতে হয়েছিল। ২০২০-২১ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ১২ হাজার ৯৮৯ কোটি টাকা। সে সময় ৬ হাজার ৯৩৩ কোটি টাকা ব্যয় করে স্বাস্থ্য বিভাগ। ফেরত যায় ৪২ শতাংশ অর্থ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৭ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৫ হাজার ৭৪১ কোটি টাকা ব্যয় হয়। বরাদ্দের ২৬ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ টাকা অব্যবহৃত থাকে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৮ হাজার ২৬১ কোটি টাকা। ব্যয় করা যায় ৭ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা, সেই হিসাবে ১১ দশমিক ২২ শতাংশ টাকা থেকে যায়।
জনগুরুত্বপূর্ণ হিসেবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে স্বাস্থ্য খাতের অর্থ ছাড় দেওয়া হয়। তবে এই অর্থবছরে যে অল্প ক’দিন আছে তাতে বাকি ৬ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা ব্যবহারের সুযোগ একেবারেই কম। অনেকেই মনে করেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বড় দুর্বলতা তারা বরাদ্দ খরচ করতে পারে না।
অগ্রাধিকার বিবেচনায় এই অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে যে মন্ত্রণালয়গুলোকে বেশি অর্থ ছাড় দেওয়া হয়েছে, এর মধ্যে সাত নম্বরে স্বাস্থ্য খাত। বেশি বরাদ্দ পাওয়া ১৫ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে এডিপি বাস্তবায়নে সবচেয়ে পেছনে রয়েছে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। তবে অন্য মন্ত্রণালয়গুলোর অর্থ বরাদ্দের অর্ধেক খরচ করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
১৫ মন্ত্রণালয় বরাদ্দের অর্থ গড়ে খরচ করেছে ৫১ দশমিক ৩০ শতাংশ। সেখানে স্বাস্থ্য বিভাগ ব্যয় করেছে ৩৩ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। সর্বোচ্চ ৬৫ শতাংশ টাকা খরচ করেছে সেতু বিভাগ। সরকারের ৫৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে এডিপি বাস্তবায়নের দিক থেকে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অবস্থান ৪৩তম। বাজেটে নিজস্ব অর্থায়ন থেকে ১৩ কোটি টাকার বরাদ্দ ছিল। গত ১০ মাসে এর এক পয়সাও খরচ করতে পারেনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
স্বাস্থ্য খাতে প্রকল্প বাস্তবায়নে এই করুণ দশার কারণ জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বাস্থ্যসেবার পরিকল্পনা অনুবিভাগের শীর্ষ এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, বিশেষ করে কভিড-পরবর্তী স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা পুনর্গঠনে অগ্রাধিকারের তালিকায় রেখেছে সরকার। তবে বিভিন্ন কারণে স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়ন প্রকল্পের বরাদ্দের অর্থ পুরোপুরি ব্যয় করা যায় না। এই অর্থবছরের মূল এডিপিতে স্বাস্থ্য খাতে ১৯ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। তবে বরাদ্দ অব্যবহৃত পড়ে থাকায় সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ কমিয়ে ১৬ হাজার ২০৪ কোটি টাকা করা হয়েছিল। এতে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা কমানো হয়েছে।
আইএমইডির প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই অর্থবছরে বিদেশি বরাদ্দ ৩ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকার মধ্যে প্রথম ১০ মাসে ১ হাজার ১২৬ কোটি টাকার খরচ করা হয়েছে। ২ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা অব্যবহৃত পড়ে আছে। এ হিসাবে বিদেশি অর্থ ব্যয় হয়েছে ৩১ শতাংশ।
এ ব্যাপারে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম সমকালকে বলেন, চিকিৎসার জন্য মানুষের বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা রোধ করতে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। এ জন্য দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নের প্রয়োজন। এ খাতকে গুরুত্ব দিয়ে স্বনির্ভর করে গড়ে তুলতে সরকার বাজেটে অর্থ বরাদ্দ দেয়। তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বরাদ্দের টাকা খরচ করতে পারে না। এটা আসলেই দুঃখজনক। এ জন্য প্রকল্প ও কর্মসূচির উপযুক্ত বাস্তবায়নের জন্য তদারকি জোরদার হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ মনে করেন, দুর্বল ব্যবস্থাপনা, অদক্ষ জনশক্তি, ব্যয়ভীতির কারণে প্রতিবছর বরাদ্দের টাকার বড় অংশ ফেরত যাচ্ছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো খরচ। বিশেষ করে ফ্যাসিলিটি পর্যায়ে খরচ ব্যবস্থাপনার অক্ষমতা। অডিটের আশঙ্কায় ব্যয় কমিয়ে রাখা হয়। পেনশন বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলার মতো শাস্তিমূলক ব্যবস্থার কারণে চাকরিও চলে যেতে পারে। স্বাস্থ্য খাতে মান উন্নয়নে বাজেটের টাকা খরচ করতে ভয়ের পরিবেশ দূর করতে হবে। দুর্নীতি একটি উদ্বেগের বিষয়, তবে এটিকে অন্য উপায়ে দমন করতে হবে। এসব উপায়ের মধ্যে থাকতে পারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অডিট ব্যবস্থা ও ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনা।
ড. হামিদের মতে, অন্য খাতে বিলম্ব হয়তো গ্রহণযোগ্য, কিন্তু হাসপাতাল সেবায় ঘাটতি থাকলে তাতে মানুষের জীবনের ঝুঁকি তৈরি হবে। স্বাস্থ্য খাতে বর্তমান বাজেটের বরাদ্দের চেয়ে তিন গুণ বরাদ্দ প্রয়োজনও বলে দাবি করেন এ বিশ্লেষক। সরকারের উচিত, ১০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হারের ওপর ভিত্তি করে আগের অর্থবছরের চেয়ে স্বাস্থ্য খাতে বাজেটে বরাদ্দ ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ১৭ শতাংশ বাড়ানো। তবে স্বাস্থ্য খাতের চাহিদা মেটাতে এ বৃদ্ধিও যথেষ্ট হবে না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ও সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ সমকালকে বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাজেট পরিকল্পনার অভিজ্ঞতার অভাব রয়েছে। এ কারণে কাজটি যেভাবে করা উচিত, সেভাবে হয় না। এ ছাড়া যারা এটি বাস্তবায়ন করে, তাদের সঙ্গে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। বরাদ্দ খরচ না হওয়ার বড় কারণ প্রকিউরমেন্ট পদ্ধতি। বাজেট পাস হওয়ার পর বাস্তবায়নের জন্য আট মাস সময় থাকে। এ সময়ের মধ্যে অনেক কাজ করা সম্ভব হয় না।
এ সমস্যা থেকে উত্তরণে কোনো কোনো সময় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কমিটি করেছে। যে সময় কমিটি হয়েছে তখন অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। পরে আবার আগের অবস্থায় ফিরেছে। এর স্থায়ী সমাধানে বাজেটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। সহযোগী কর্মচারীদের মান বাড়াতে হবে। একসঙ্গে দুই বছরের প্রকিউরমেন্ট করা জরুরি।
তিনি আরও বলেন, প্রতিবছর অর্থ ফেরত যাওয়ার কারণে অনেক ক্ষেত্রে প্রভাব পড়ছে। জনস্বাস্থ্য-সংশ্লিষ্ট যে কর্মসূচিগুলো রয়েছে, সেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যেমন– কলেরা, কালাজ্বর, কুষ্ঠ, যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি ব্যাহত হচ্ছে। শিশু ও মাতৃমৃত্যুতে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে প্রভাব পড়ছে।
- বিষয় :
- স্বাস্থ্য খাত
- স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়