বিএনপির রাজপথের কর্মসূচি ঘিরিয়া পুনরায় যেই পরিস্থিতির উদ্ভব হইতেছে, উহা অনাকাঙ্ক্ষিত। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধসহ বিভিন্ন দাবিতে রাজপথের প্রধান বিরোধী দলটি শনিবার ১৮টি জেলা ও মহানগরে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করিতেছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক অতীতের ন্যায় এইবারও উহাতে বাদ সাধিয়াছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মী। রবিবার সমকালসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনসূত্রে জানা যাইতেছে, আলোচ্য কর্মসূচি পালনকালে পটুয়াখালী, রাজবাড়ী ও নেত্রকোনায় ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীর হামলায় বিএনপির শতাধিক নেতাকর্মী আহত হয়। বলা বাহুল্য, হামলাকারীদিগের সহিত পুলিশও যোগ দিয়াছিল; দৃশ্যত আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নামে। যেই কারণে হামলার শিকার হইবার পাশাপাশি খুলনা, রাজশাহী, রাজবাড়ী ও নেত্রকোনায় বিএনপির শতাধিক নেতাকর্মী আটকও হইয়াছে। বিরোধী দলের কর্মসূচিতে শাসক দলের এহেন আক্রমণ শুধু অনাকাঙ্ক্ষিত নহে; উদ্বেগজনকও বটে। এই সম্পাদকীয় স্তম্ভে আমরা ইতোপূর্বে একাধিকবার বলিয়াছি, বাংলাদেশের সংবিধান নাগরিকদের সংগঠন ও সমাবেশ করিবার অধিকার দিয়াছে; এবং যতক্ষণ কোনো সমাবেশ বা কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ থাকে ততক্ষণ উহাতে বাধা প্রদানের অধিকার কাহারও নাই। অধিকন্তু কোনো কর্মসূচির কারণে শান্তিভঙ্গের শঙ্কা থাকিলে উহাতে শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীই হস্তক্ষেপ করিতে পারে; অন্য কাহারও সেই অধিকার নাই।

হতাশাজনক, সাম্প্রতিক মাসগুলিতে যখনই বিরোধী দল রাজপথে কোনো কর্মসূচি ঘোষণা করিয়াছে; তখনই আওয়ামী লীগ এবং উহার সমর্থনপুষ্ট ছাত্র ও যুব সংগঠনগুলি পাল্টা কর্মসূচি দিয়াছে। অনিবার্য পরিণতিস্বরূপ দুই দলের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটিয়াছে। অধিকতর উদ্বেগজনক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এই ধরনের পরিস্থিতিতে বরাবরই শাসক দলের পক্ষাবলম্বন করিতে দেখা যায়, যাহা সাংবিধানিকভাবেও গ্রহণযোগ্য নহে। ইহা সত্য, বিরোধী দলের কর্মসূচিতে শাসক দলের নেতাকর্মীর বাধাদান এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শেষোক্তদের পক্ষাবলম্বন নূতন কোনো প্রবণতা নহে; অতীত সরকারসমূহের আমলেও একই ঘটনা বারংবার পরিলক্ষিত হইয়াছে। কিন্তু অতীত সরকারের কোনো ভুল বা অন্যায় বর্তমান সরকারের একই ভুল বা অন্যায়কে ন্যায্যতা দিতে পারে না। আমরা মনে করি, গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখিতে এই অসুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি হইতে বাহির হইয়া আসিতে হইবে। এই ক্ষেত্রে উভয় দলেরই ভূমিকা রাখা আবশ্যক। তবে রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপক হিসাবে ক্ষমতাসীন দলকেই অগ্রণী ভূমিকা লইতে হইবে।

আমরা জানি, আগামী জাতীয় নির্বাচন লইয়া বিগত ৫২ বছরের মধ্যে অধিকাংশ সময় পালাক্রমে দেশ শাসনকারী আওয়ামী লীগ ও উহার প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি কার্যত মুখোমুখি অবস্থানে রহিয়াছে। ক্ষমতাসীন দল অন্য সকল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ন্যায় বিদ্যমান সরকার তথা তাহাদের অধীনেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে সওয়াল করিতেছে। অপরপক্ষে বিএনপির বক্তব্য, উহারা কোনোমতেই দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠেয় কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করিবে না। দুই পক্ষের এহেন অনড় অবস্থানের কারণে পরিস্থিতি দিন দিন উত্তপ্ত হইয়া উঠিতেছে। ইহারই প্রতিফলন ঘটিতেছে রাজপথে। কিন্তু এই অবস্থার পরিণাম অন্তত দেশের অর্থনীতির পক্ষে সহ্য করা সম্ভব কিনা, উহাও ভাবিয়া দেখিবার বিষয়। এমনিতেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন কারণে মূল্যস্ফীতির মারাত্মক উল্লম্ফন ঘটিয়াছে; বিশেষত ডলার সংকটের কারণে আমদানি ব্যবস্থা বিঘ্নিত হইতেছে। সর্বোপরি সিংহভাগ মানুষের প্রকৃত আয় বৃদ্ধি না পাইবার কারণে তাহারা অতিকষ্টে দিনাতিপাত করিতেছে। এহেন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক বিরোধ দীর্ঘতর হইলে সাধারণ মানুষের বোঝার উপর শাকের আঁটিই উঠিয়া যাইবে।

ইতোপূর্বে বহুবার রাজনীতির দুই পক্ষকে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের তাগিদ দিয়াছি। আমরা মনে করি, যেই কোনো সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান যেমন সর্বোত্তম, তেমনি পারস্পরিক আলোচনাই হইল উহা অর্জনের একমাত্র পথ। এই ক্ষেত্রে সংলাপেই সমাধান এবং সংলাপের বিকল্প নাই। সংলাপ যদি কঠিন হইয়া পড়ে, তাহা নিরসনেও সংলাপই একমাত্র পথ।

আমরা মনে করি, অবশ্যই দুই পক্ষকে সমঝোতার মনোভাব প্রদর্শন করিতে হইবে; তবে সংলাপের পরিবেশ সৃষ্টির দায় প্রথমত শাসক দলের। স্বীকার করিতে হইবে, সরকারি দলসহ সকলেই একটা অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের গুরুত্ব অনুভব করিতেছে। আর বিএনপিকে বাহিরে রাখিয়া অনুষ্ঠিত নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতার সংকটে পড়িবে। কিন্তু সংলাপের পরিবেশ সৃষ্টি করিতে হইলে প্রথমেই বিরোধী দলের কর্মসূচিতে বাধা প্রদান বন্ধ হওয়া দরকার।