রাজধানীর আজিমপুরের সাদিয়া আফরিন ফিস্টুলা রোগে ভুগছেন ২৩ বছর ধরে। তাঁর বয়স ৫০ বছর। প্রথম সন্তান জন্মদানের সময় বাধাগ্রস্ত প্রসবের কারণে এ রোগে আক্রান্ত হন তিনি। প্রসবব্যথা ওঠার তিন দিন পর ক্লিনিকে নেওয়া হয় তাঁকে। ততক্ষণে গর্ভের সন্তান মারা যায়। এরপর আর সন্তান হয়নি তাঁর। এমন বাধাগ্রস্ত প্রসবের ক্ষেত্রে ৫৭ শতাংশ নারী ফিস্টুলায় আক্রান্ত হচ্ছেন। জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) জরিপ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

এই জরিপে দেশের ১৫টি সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সেবা নেওয়া ৫২৪ জন ফিস্টুলা রোগীর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। এতে দেখা গেছে, প্রসবজনিত (বাধাগ্রস্ত প্রসব) কারণে ফিস্টুলা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে ৫৭ শতাংশের। জরায়ু অপসারণ করতে যে অস্ত্রোপচার হয়, সে ক্ষেত্রে ৫৬ শতাংশ এবং অস্ত্রোপচারে সন্তান প্রসবের পরবর্তী আঘাতের কারণে ৪০ শতাংশ নায়ী ফিস্টুলায় আক্রান্ত হচ্ছেন। তবে সঠিক অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ৯৩ শতাংশ রোগীর ফিস্টুলা সারানো সম্ভব।

জরিপে জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে কিশোরীদের মধ্যে ফিস্টুলা আক্রান্তের হার বেশি। প্রথম সন্তান নেওয়ার সময় ৯৪ শতাংশ কিশোরীর এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এর মধ্যে ৬৪ শতাংশ প্রসূতি এ রোগে আক্রান্ত হয়েছে। তিন বাচ্চা জন্ম দেওয়া নারীর মধ্যে ৬১ শতাংশ কোনো সময় ফিস্টুলায় আক্রান্ত হন। ফিস্টুলা আক্রান্ত ৮৫ শতাংশ রোগী নিরক্ষর। বর্তমানে রংপুর ও সিলেট বিভাগে রোগীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি।

সংশ্লিষ্টদের ধারণা, গত ১০ বছরে দেশে ফিস্টুলা রোগী দ্বিগুণ হয়েছে। বাংলাদেশে ফিস্টুলার চিকিৎসক অনেক কম। দেশে সন্তান জন্মদান ৬৪ থেকে ৬৫ শতাংশ বাড়িতে হচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, দেশে আনুমানিক ১ লাখ ২০ হাজার নারী প্রসবজনিত ফিস্টুলায় ভুগছেন। প্রতি এক হাজার বিবাহিত নারীর মধ্যে প্রসবজনিত ফিস্টুলায় আক্রান্তের হার ১ দশমিক ৬৯। বিশ্বে প্রতিদিন প্রায় ৮০০ নারী অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় বা সন্তান প্রসবের সময় মারা যান। বাংলাদেশে এ রকম মৃত্যু হয় প্রতিদিন গড়ে ১৫ জন। এ পরিস্থিতিতে আজ ২৩ মে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক প্রসবজনিত ফিস্টুলা নির্মূল দিবস। ২০০৩ সালে জাতিসংঘ এই দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নানা আয়োজনের মাধ্যমে এ দিবস পালন করা হচ্ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশে বছরে দুই হাজার নারী ফিস্টুলায় আক্রান্ত হন। তবে অনেক নারী গোপন রাখায় ফিস্টুলার সঠিক পরিসংখ্যান জানা কঠিন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে জাতীয় ফিস্টুলা সেন্টারসহ দেশের ১১টি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বিনামূল্যে রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হয়। সরকারিভাবে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ইউএনএফপিএর সহায়তায় পরিচালিত প্রকল্পের আওতায় পুনর্বাসন কেন্দ্রে ৩০০ নারীর থাকার ব্যবস্থা আছে। প্রশিক্ষণ পেয়ে এই নারীরা অনেকটাই আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গাইনি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নুসরাত আফরিন নীলা বলেন, বাধাগ্রস্ত সন্তান প্রসবের কারণে অনেক নারীকে ফিস্টুলার মতো জটিল সমস্যায় ভুগতে হয়। ফিস্টুলা আক্রান্ত নারীর অনবরত প্রস্রাব-পায়খানা ঝরতে থাকে। এ কারণে জননাঙ্গে চুলকানি হয়, ক্ষত তৈরি হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত হলে ফিস্টুলা চিকিৎসার মাধ্যমে পুরোপুরি ভালো হয়ে যায়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এ-সংক্রান্ত কর্মসূচির প্রোগ্রাম ম্যানেজার আজিজুল আলিম সমকালকে বলেন, প্রসবজনিত ফিস্টুলা নির্মূলে ডাক্তার, প্রশিক্ষিত সেবাদানকারী বা মিডওয়াইফদের মাধ্যমে গর্ভকালীন ও প্রসবকালীন সেবা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। এ জন্য দরকার সরকারি-বেসরকারি মাধ্যমে সচেতনতামূলক কর্মসূচি। দেশে ২০৩০ সালের মধ্যে প্রসবজনিত ফিস্টুলা নির্মূল করার লক্ষ্য বাস্তবায়নে সফলতা আনতে হলে বাল্যবিয়ে, অল্প বয়সে গর্ভধারণ রোধ করতে হবে এবং মাতৃত্বকালীন সব সেবা নিশ্চিত করতে হবে।