
কিশোরীদের দেখা মুক্তিযুদ্ধ, লেখক- সুরমা জাহিদ, প্রকাশক-অনিন্দ্য প্রকাশ, প্রচ্ছদ-মাসুক হেলাল, দাম-৩০০ টাকা
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে যাঁরা কিশোরী ছিলেন, তাঁরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য, নিজের মানসম্মান বাঁচাতে যুদ্ধ করেছেন নিজের সাথে। সেইসব কিশোরীর বাস্তব জীবনের আখ্যান এই বই। বলা যায়, সুরমা জাহিদের ‘কিশোরীদের দেখা মুক্তিযুদ্ধ’ গ্রন্থটি ৪৫ জন কিশোরীর আত্মকথন। এই গল্পগুলো বাস্তব জীবন থেকে নেওয়া। লেখক হালিমা খাতুন নাম দিয়ে এক কিশোরীর গল্প দিয়ে গ্রন্থটি শুরু করেন এবং শেষ করেন মল্লিকা বেগমের গল্পের মধ্য দিয়ে। প্রতিটি গল্প সেই সময়ে কিশোরীদের জীবনকে জানতে সহযোগিতা করবে। মুক্তিযুদ্ধকালীন কিশোরীদের বেঁচে থাকার ভয়াবহতার বর্ণনা সম্পর্কে জানা যাবে। হালিমা নামের কিশোরী হঠাৎ করে একদিন জানতে পারে, বাজারে পাকিস্তানি সেনারা লুটপাট করছে। নারীদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে, হত্যা করছে নিরীহ মানুষকে। গ্রামের ভেতর মিলিটারি প্রবেশ করছে, তাদের বাড়িতে এমন খবর যায়। পুরুষ মানুষ সবাই পালিয়ে যায়। হালিমাকে রাখা হয় ধানের গোলার ভেতর। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সেখানে থাকে। কেউ সিন্দুকের ভেতর রেখে দেয়। খাওয়াদাওয়া সব ভুলে যায়। পরে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হলে নিজ বাড়ি ত্যাগ করে চলে যায় দূরে কোথাও।
প্রতিটি ঘটনার মাঝে লুকিয়ে আছে নির্মমতা থেকে নিজেদের রক্ষা পাবার আকুতি। জীবন বাঁচানোর চেয়ে, সম্মান রক্ষা করা যেন পরিবাবের কাছে মুখ্য। কাউকে ধানের গোলার ভেতর রেখে, ওপরে আটকিয়ে দেয়। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার কথা বললে, পাশ থেকে দাদি জানায় মারা গেলে সমস্যা নেই। কিন্তু মানসম্মান চলে গেলে সব শেষ হয়ে যাবে। কোনো কোনো গল্পে এমন ভয়াবহ ঘটনা উঠে এসেছে। পাকিস্তানি হায়েনাদের থেকে জঙ্গলে পালানো নিরাপদ ভেবেছেন কিশোরীরা। বাড়িঘর রেখে একাকী কোনো জঙ্গলে কাটিয়ে দেবার ঘটনা আছে কিশোরীর। দুয়েক দিন পরপর শুকনো খাবার দিলে পেটে কিছু জোটে, কেউ নিকটে না পৌঁছালে খাবার জোটে না। হতাভাগা মানবী হয়ে জঙ্গলে অপেক্ষায় থাকে কখন আপনজন আসবে। একটু পেটে খাবার জুটবে। তবে চোখে-মুখে থাকে ভয়ের চিহ্ন। কোনো ঘটনায় চোখের সামনে নির্মমভাবে তুলে নেওয়া হয় প্রিয় কোনো মানুষকে। এক কিশোরীর বর্ণনা পড়ে চোখের জলে বইয়ের পাতা ভিজে যায়। ঘটনাটি ছিল এমন– এক কিশোরী, দাদি আর তার বোন নিজেদের বাঁচানোর জন্য কোথাও যাচ্ছে। হঠাৎ কিশোরী দেখেন মিলিটারি ধেয়ে আসছে। সে কোনো কূলকিনারা না পেয়ে গাছের ওপর ওঠে। মিলিটারিরা এসে তার দাদির হাত বেঁধে ফেলে। তার বোনকে তুলে নিয়ে যায়। কিশোরীটি নিরুপায় হয়ে চুপচাপ থাকে। তারও ভয়, সম্মান যেভাবে হোক রক্ষা করতে হবে। দুভার্গ্যবশত সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায় গাছ থেকে। কিন্তু যখন সেই কিশোরীর জ্ঞান ফেরে, তখন দেখে সে কারও বাড়িতে। গাছ থেকে পড়ে তার হাত ভেঙে গেছে। পুরো শরীর ব্যথায় কাতর। সেই ভাঙা হাত আর অসুস্থ শরীর নিয়ে জঙ্গলে জঙ্গলে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। নিজেকে রক্ষা করেছে। কোনো কিশোরী টয়লেটে গেছে। তখন শুনতে পায় মিলিটারি বাড়িতে প্রবেশ করেছে। ভয়ে সে আর টয়লেট থেকে বের হয়নি। কয়েক ঘণ্টা টয়লেটে থেকে অসুস্থ হয়ে পড়ে। তবুও নীরবে থেকেছে। মিলিটারি থেকে নিজেকে রক্ষা করতে এ ছাড়া কোনো উপায় ছিল না।
মাধবী সেন নামে একজন কলকাতা থেকে মায়ের অনুরোধে বিয়ে খেতে আসেন বাংলাদেশে। বিয়ের কয়েক দিন পর মামা অসুস্থ হয়ে যায়। তাই তাদের কলকাতাতে ফিরতে দেরি হয়। এর ভেতর শুরু হয় যুদ্ধ। হঠাৎ একদিন তার মামার বাড়িতে মিলিটারি চলে আসে। তাকে ধানের গোলাতে লুকিয়ে রাখে। মিলিটারিরা ঘরে ঢুকে ধানের গোলাতে লাথি দেয়। ভয়ে মাধবী জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।
মুক্তিযুদ্ধের এমন অনেক ঘটনা বইটিতে সংক্ষিপ্ত আকারে সাজানো হলেও, সে সময়কার পুরো বিষয় উঠে এসেছে। ৪৫ জন কিশোরী যেন তখনকার সব কিশোরীর প্রতিনিধি হয়ে নির্মমতার কথা বলেছেন। বর্ণনা করেছেন হৃদয়ের গহিন বেদনা আর রক্তক্ষরণের কাহিনি। গল্পগুলো অনুপ্রেরণামূলক হয়ে অনেকের জীবন পথ চলার সাহস জোগান দেবে। তবে কিশোরীদের গল্পে কোনো স্থানের উল্লেখ নেই। এতে করে কোন এলাকার তা আড়ালে থেকে যায়। হয়তো লেখক এমনটি চেয়েছেন। তবে এলাকার নাম থাকলে, গল্পে বাস্তবতার ভিতটা আরও মজবুত হতো, বলা যায়।
মন্তব্য করুন