
তৎপুরুষ, লেখক-আব্দুল্লাহ শুভ্র, প্রকাশক- কবি প্রকাশনী, প্রচ্ছদ-ধ্রুব এষ, দাম-৩৭৫ টাকা
কবি ও ঔপন্যাসিক আব্দুল্লাহ শুভ্র ‘তৎপুরুষ’ উপন্যাসে মানবজীবনকে শেষ পরিণতিতে ইতিবাচক অনুধ্যানে উপস্থাপন করেছেন। নর-নারী সম্পর্কের জটিল খোল-নলচের স্বরূপ উন্মোচনে খল কিংবা প্রতারক চরিত্রের অনিবার্য আবির্ভাব কাহিনিকে নাটকীয় করে তুলেছে সত্য কিন্তু এসব ক্ষেত্রে ঘটনার চমক থাকলেও শেষ পর্যন্ত মানুষের অপরিসীম ত্যাগ, সহিষ্ণুতা আর উত্তম জীবনের আকাঙ্ক্ষা সমুজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। নামকরণের ক্ষেত্রে তিনি ভিন্ন পথের যাত্রী। ‘তৎপুরুষ’ বাংলা ভাষার একটি ‘সমাসে’র নাম, তবে এই বিশেষ্য পদটি দিয়ে ‘সেই পুরুষ’, ‘পরমপুরুষ’ প্রভৃতি আলোচ্য উপন্যাসের মূল প্রতিপাদ্যের জন্য অভিনব। নায়িকা গুলেনূরের জীবনে সেই ব্যক্তিটি কে? পরপুরুষ সালামত নাকি স্বামী সুলতান? অসম বয়সী নারীর প্রতি পুরুষের আকর্ষণ, জীবনের অতৃপ্তি বোধ থেকে রহস্যময় ছায়ামানবীর বারবার আগমন ও প্রস্থান এবং গ্রামীণ সমাজে সংগ্রামরত নারীর ব্যক্তিত্ব-চেতনা আর জেলজীবন ও পল্লিজীবনে একজনের ব্যক্তিগত স্পেসের মধ্যে অন্যের মাতব্বরি প্রভৃতি প্রসঙ্গ কথাকার আব্দুল্লাহ শুভ্র কুশলী বাকভঙ্গিমায় রূপায়িত করেছেন।
আইএসসি পাস উত্তরবঙ্গের এক গ্রামের ছেলে সালামত। ৩২ বছরের পুরোটা জীবন দুঃখ-দুর্দশায় ভরা। তার পিতার পুকুরে ডুবে মৃত্যু থেকে শুরু করে সব দুর্ঘটনা একটি নির্দিষ্ট তারিখের রহস্যময় চক্করে ঘেরা। বিষাদের প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে ১১ তারিখটি জড়িয়ে থাকে। সালামত নিজেকে অলক্ষ্মী ভাবে। এনজিওর চাকরির সুবাদে গ্রামীণ জীবনে কিছুটা স্বস্তি ফিরে এলেও এর পরই অপ্রত্যাশিত সব ঘটনা ঘটতে থাকে। পরপর দুই স্ত্রী বিয়োগে নিঃসঙ্গ সালামতের জীবনে রহস্যময় ছায়ামানবী রাত গভীর হলেই তার শোবার ঘরে হেঁটে বেড়ায়। পাশাপাশি বাস্তবেই তার নিঃসঙ্গ জীবনে আসে গুলেনূর। দুই সন্তানের জননী। তার চেয়ে বয়সে বেশ বড়, অপরূপা। বিপদে পড়ে তার বাসায় রান্নার কাজ করে। গুলেনূরের স্বামী সুলতান প্রতারণার মামলায় জেলখানায় বন্দি। সুলতান তার স্ত্রী ও সন্তানদের বুকে আগলে রাখতে চায়। কিন্তু নিজের স্ত্রী সম্পর্কে জেলফেরত সুলতান গ্রামীণ সমাজের নানা কুৎসায় অস্থির হয়ে দূরে চলে যায়। অন্যদিকে সালামতও চাকরি ছেড়ে নিজের গ্রামে ফিরে আসে। দূর থেকে লেখা সুলতানের চিঠির মধ্য দিয়ে উপন্যাসটি শেষ হয়। যে চিঠি পড়ে গুলেনূরের দু’চোখ ভিজে যায়। সুলতানের অপেক্ষায় থাকে সে।
নর-নারী সম্পর্কের টানাপোড়েনের ভেতর গ্রামীণ সমাজ বাস্তবতার চিত্র ‘তৎপুরুষ’কে যথার্থ অর্থেই সার্থক আখ্যানে পরিণত করেছে। এ উপন্যাসে ব্যক্তিক সম্পর্কের সূত্রে সমাজের অন্তর্গত সমস্যাগুলো তুলে ধরা হয়েছে। ঔপন্যাসিক উপন্যাসটিতে সমাজের অসংগতিগুলো কেবল সমালোচনা করার জন্য ব্যবহার করেননি বরং গ্রামীণ জীবনের সামাজিক ইতিহাসকেও চিহ্নিত করেছেন। অন্যদিকে সমাজের বিভিন্ন সমস্যা অন্বেষণ করার সময় মধ্যবিত্ত ও নিম্নবর্গের জীবনের বাস্তবতার ভেতর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বলয়কে স্পর্শ করেছেন।
‘তৎপুরুষ’ উপন্যাসে এমন কতগুলো চরিত্র আছে, যাদের চিত্রিত করে লেখক গ্রামীণ সমাজের মনোজগতের পরিচয় উপস্থাপন করেছেন। শ্রমজীবী ও দরিদ্র, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, প্রতারক চক্র প্রভৃতি জনগোষ্ঠীর একটা সাধারণ পরিচয় মূল কাহিনিকে বিকশিত করার জন্য অনিবার্যভাবে এসেছে।
কীভাবে মানুষ খুব সহজে অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে আটকে যায়, আবার তা থেকে রক্ষা পায়– সে বিবরণও উপন্যাসে গুলেনূরের জীবন বাস্তবতায় ফুটে উঠেছে। সমাজে অন্যায় অবিচারের প্রতিবাদ করার মতো সক্ষমতা কোনো চরিত্রে প্রকাশ না পেলেও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠায় ঔপন্যাসিক শেষাবধি তৎপর বলে পাঠকের কাছে মনে হবে। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিতে গ্রামীণ জীবনে প্রেমের আলেখ্য রূপায়ণে তিনি কয়েকটি দিন ও রাতের বৃষ্টির যে বর্ণনা দিয়েছেন তা চরিত্রের মনোরাজ্যের স্বরূপ প্রকাশের ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। ক্লাস টেন পর্যন্ত পড়া গুলেনূরের দুই কন্যার মধ্যে একজনের প্রেম সম্পর্কের দৃশ্যরূপ এবং ছোট মেয়ের গলায় মাছের কাঁটা বিদ্ধ হওয়ার পর হাসপাতালে সালামত ও গুলেনূরের পরস্পরের কাছাকাছি আসার প্রত্যাশা স্বাভাবিক হলেও ঔপন্যাসিক হালকা বা জোলো করে তোলেননি ঘটনাগুলো। বরং নাটকীয় সংকটের ঘনীভূত এক দৃশ্য অঙ্কন করেছেন সালামতের বাসায় ব্যক্তিত্বময় গুলেনূরের তর্কবিতর্কের প্রেক্ষিতে। আসলে গুলেনূরের মতো দরিদ্র মানুষের জীবনযাপন এবং রোগব্যাধির বাস্তবতায় স্থাপিত সামাজিক অভিজ্ঞতাই তিনি অভিনবত্বের সঙ্গে তুলে ধরেছেন।
‘তৎপুরুষ’ উপন্যাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক নারীর ব্যক্তিত্ব। নিরুদ্দিষ্ট সুলতানের রূপসী স্ত্রী গুলেনূর সালামতের প্রেমে সাড়া দেয়নি। বরং কন্যার অসুস্থতায় সাহায্য করার বিনিময়ে তাকে নির্ভরশীল করে তোলার সালামতের গোপন ইচ্ছেও সফল হয়নি এই নারীর দৃঢ়চেতা ও স্পষ্ট বক্তব্যের কারণে। পাঠকের মনে হতে পারে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়া এবং প্রেমের টানে সুলতানের সঙ্গে পিতৃগৃহ ত্যাগ করে আসা এই নারী কীভাবে এই ব্যক্তিত্ব অর্জন করল। আসলে গুলেনূরকে ঔপন্যাসিক আদর্শ নারীর প্রতিমূর্তিতে দাঁড় করিয়েছেন। আব্দুল্লাহ শুভ্র উপন্যাসে কাহিনিবিন্যাসের আধুনিক কলাকৌশল তথা রীতিনীতির চেয়ে চরিত্র চিত্রণের দিকে বেশি মনোযোগী। অবশ্য উপন্যাসের প্লট নির্মাণে তাঁর দক্ষতাকে অস্বীকার করা যাবে না। এজন্য বলা যায় ‘তৎপুরুষ’ উপন্যাসের চরিত্রগুলোর আর্থসামাজিক অবস্থা, তাদের নৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক অভীপ্সা তিনি অনুপুঙ্খ অভিনিবেশে তুলে ধরেছেন।
‘তৎপুরুষ’ পাঠযোগ্য ও চিন্তাকে নাড়া দিতে সক্ষম একটি উপন্যাস। আব্দুল্লাহ শুভ্রর উপন্যাস রচনার ধারাবাহিক প্রচেষ্টায় এটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন।
মন্তব্য করুন