নতুন মার্কিন ভিসা নীতি এক ধরনের সতর্কতা। আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে আরও নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কা রয়েছে। নতুন ভিসা নীতির কারণে বাংলাদেশ একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করে ফেলবে– এমনটা মনে করা ঠিক নয়। তবে এই ভিসা নীতির একটি সর্বব্যাপী প্রভাব আছে।

‘নতুন মার্কিন ভিসা নীতি ও বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন’ শীর্ষক ওয়েবিনারে গতকাল রোববার বক্তারা এসব কথা বলেছেন। এর আয়োজন করে ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বেসরকারি ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক জাহেদুর রহমান। তিনি বৈশ্বিক রাজনীতির প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলেন, পরাশক্তিরা এখানে কাজ করছে। সংঘাতময় একটি পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নাইজেরিয়ায়ও একই ধরনের (ভিসা নীতির মতো) নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল। এখানে বিচার বিভাগকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এটি কোনোভাবেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।

ওয়েবিনার সঞ্চালনা করেন ফ্রাই ইউনিভার্সিটি অব ব্রাসেলসের ফেলো সাইমুম পারভেজ। বক্তব্য দেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের সম্মাননীয় অধ্যাপক আলী রীয়াজ, ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি মালয়েশিয়ার অধ্যাপক মাহমুদুল হাসান, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন, নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহেদুল আনাম খান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক এম. শহীদুজ্জামান।

তৌহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশের কাছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমদানির চেয়ে রপ্তানির জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ। রেমিট্যান্সের একটা বড় উৎস যুক্তরাষ্ট্র এবং রপ্তানির জন্য বড় একটি জায়গা। তিনি বলেন, সবাই বলছে কোনো সমস্যা না। যদি ভোট সুষ্ঠু হয়, তাহলে তো আসলেই কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। মূল কথা হলো, মানুষ ভোট দিতে পারবে এবং যাকে ভোট দেবে তাকেই বিজয়ী হিসেবে দেখা যাবে। তবে এটা ঘটার জন্য পরিবেশ তৈরি করতে হবে।

তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্ভব নয়– এ কথা বলে লাভ নেই। কারণ, একসময় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল না, প্রয়োজনে এই ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। যদি আবারও প্রয়োজন হয়, তাহলে আসতে কোনো সমস্যা নেই। আইন মানুষই তৈরি করে।

মার্কিন নতুন ভিসা নীতি কতটুকু কার্যকর হবে তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে তৌহিদ হোসেন বলেন, আজ থেকে ২০ বছর আগে হলে এই নীতি তেমন প্রভাব ফেলত না। কারণ তখন মানুষের আমেরিকায় যাওয়ার সামর্থ্য কম ছিল। এখন নিচু পর্যায়ের কর্মকর্তা ও ছোট রাজনৈতিক  নেতাকেও যুক্তরাষ্ট্রে যেতে দেখা যায়। ২০ বছর আগে তাঁদের তেমন কোনো স্বার্থ না থাকলেও এখন রয়েছে। কাজেই এখন এসব ব্যক্তির মাথায় থাকবে নির্বাচনী অনিয়মে জড়ালে আমেরিকায় থাকা তাঁর স্ত্রী-সন্তানের কী হবে?

তৌহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশে ভারত ও চীনেরও স্বার্থ আছে। ভারতের জন্য আওয়ামী লীগ সরকার সুবিধাজনক। নির্বাচনের এখনও সাত মাস বাকি। এ সময়ের মধ্যে সরকার বিষয়টিকে কীভাবে মোকাবিলা করে– এটি দেখার বিষয়। ভারতের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকার অনেক ঘনিষ্ঠ। ভারত তার নিজের স্বার্থেই আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখতে চাইবে। এখানে যত পরিবর্তনই হোক না কেন– ভারতের নিজের স্বার্থ রক্ষার সার্মথ্য রয়েছে।

অধ্যাপক শহীদুজ্জামান বলেন, পশ্চিমাদের কাছে এই সরকারের সবচেয়ে শক্তিশালী যুক্তি ছিল, মৌলবাদের বিরুদ্ধে তারাই হচ্ছে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সরকার। বাংলাদেশে যেসব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটেছে, সেগুলো আইন প্রয়োগকারী সংস্থা প্রতিহত করতে পেরেছে। এ জন্য পশ্চিমা বিশ্ব কিন্তু এই সরকারের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করতে পেরেছে। কিন্তু এই সরকার শুধু মৌলবাদকে ঠেকাবে– তা আর যুক্তরাষ্ট্র গ্রহণ করছে না।

নতুন ভিসা নীতি প্রকাশের পরে এক আমলা তাঁর পাশের রুমের আরেক আমলার কাছে গিয়ে দরজা বন্ধ করে আলোচনা করছে; এটা কী হলো। এখন তাঁর কী হবে, পরিবারের কী হবে। স্ত্রী আর তাঁকে এ পথে যেতে দেবে না। তিনি বলেন, ভারত চায় এই সরকার টিকে থাকবে। ভারতের নীতিতে পরিবর্তন আসবে না। 

অধ্যাপক শহীদুজ্জামান বলেন, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বাংলাদেশ এখন খেলোয়াড়। কিন্তু দেশের পররাষ্ট্রনীতিতে জাতীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ন হচ্ছে। স্বার্থ বেশি দেখা যাচ্ছে। তাঁর ধারণা, সামনের মাসগুলোতে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসবে।

অধ্যাপক আলী রিয়াজ বলেন, বাংলাদেশ নিয়ে বিশ্ব রাজনীতির তিন বড় পরাশক্তির প্রতিযোগিতার পেছনে রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে জনগণের ম্যান্ডেটবিহীন সরকার।  তিনি  বলেন, ২০১৪ বা ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে ভারত যতটা সোচ্চার ছিল, এখন সেটা নেই। তাঁর ধারণা, দিল্লি ও ওয়াশিংটনের মধ্যে কোনো আলোচনা চলছে।

তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতির কারণে বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হয়ে যাবে, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হবে– এমনটা মনে করেন না। এই নীতির প্রভাব সীমিত। তবে এটি একটি সতর্কবার্তা। এখন থেকে আরও ব্যবস্থা আসবে বলে তিনি ধারণা করেন। তিনি মনে করেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকেই সমাধান বের করতে হবে, নিরপেক্ষ প্রশাসন তৈরি করতে হবে। শাহেদুল আনাম খান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি কীভাবে কার্যকর হবে– সেই প্রশ্নও রয়েছে।