মে মাসে এসে বাংলাদেশের কূটনৈতিক ক্ষেত্রে পরপর বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। এর সর্বশেষটি হলো যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে নতুন ভিসা নীতি। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইটে ‘বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন উৎসাহিত করতে ভিসা নীতির ঘোষণা’ শিরোনামে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। বিবৃতিতে অ্যান্টনি জে. ব্লিংকেন বলেন, বাংলাদেশে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করার লক্ষ্যকে সহায়তা করতে তিনি ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ন্যাশনালিটি অ্যাক্টের অধীনে নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করছেন। এই নীতির অধীনে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত বলে মনে করা যে কোনো বাংলাদেশির জন্য ভিসা প্রদানে বিধিনিষেধ আরোপে সক্ষম হবে। এর মধ্যে বর্তমান ও সাবেক বাংলাদেশি কর্মকর্তা ও কর্মচারী, সরকারপন্থি ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার বিভাগ এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত থাকবেন। (সমকাল, ২৪ মে ২০২৩)।

এই ভিসা নীতি বিভিন্ন বিবেচনায় বিস্ময়কর– স্বীকার করতে হবে। কিন্তু বিষয়টি ঠিক বিনা মেঘে বজ্রপাত নয়। বিরোধী দল ও নাগরিক সমাজের একটি অংশ যেভাবে সব শেষ হয়ে গেল বলে রব তুলেছে, সেটাও বাস্তবসম্মত নয়। দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও তার মিত্র রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে অনেক দিন ধরেই মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ‘ভয়’ দেখানো হচ্ছিল। গত বছর যখন দলটি বিভিন্ন বিভাগীয় সমাবেশ সম্পন্ন করে ১০ ডিসেম্বর ঢাকার জন্য তারিখ নির্ধারণ করেছিল, তখনও কথা উঠেছিল। বিরোধী দলের পক্ষে প্রচারণা চালানো হয়েছিল– ১০ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে নতুন করে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে। একজন বিএনপি নেতা আরও এক ধাপ এগিয়ে বলেছিলেন, ১০ তারিখের পর দেশ চলবে খালেদা জিয়ার আদেশে। বাস্তবে তেমন কিছুই ঘটেনি। বরং বিএনপির ওই মহাসমাবেশ শেষ পর্যন্ত হযবরল অবস্থায় শেষ হয়েছে।

যা হোক, নতুন ভিসা নীতি ঘোষণার আগে কূটনৈতিক অঙ্গনে বড় খবর ছিল, বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, সৌদি আরব, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের রাষ্ট্রদূত বা হাইকমিশনারের অতিরিক্ত নিরাপত্তা প্রত্যাহারের ঘোষণা। মূলত যেসব রাষ্ট্রদূত বা হাইকমিশনার বাইরে চলাচলের সময় অতিরিক্ত পুলিশি নিরাপত্তা বা এস্কর্ট সুবিধা পেতেন, সেই সুবিধা প্রত্যাহার। তবে রাষ্ট্রদূতদের নিরাপত্তায় নিয়োজিত গানম্যান দায়িত্ব পালন করে যাবেন। একই সঙ্গে ঢাকার সব কূটনীতিক, মন্ত্রী, সচিব ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা প্রটোকলে পুলিশের পরিবর্তে আনসার নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়। কারও অতিরিক্ত নিরাপত্তা লাগলে পুলিশের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনও এ প্রসঙ্গে সংবাদমাধ্যমকে জানান, ‘বিশেষ পরিস্থিতিতে কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রদূতকে বাড়তি নিরাপত্তা-সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এখন বাংলাদেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যথেষ্ট ভালো। জঙ্গি দমনে সারাবিশ্বে রোল মডেল বাংলাদেশ। তাই কূটনীতিকদের বাড়তি নিরাপত্তা-সুবিধা দিলে বিদেশিদের কাছে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও নিরাপত্তা নিয়ে ভুল বার্তা যায়।’ (সমকাল, ১৮ মে ২০২৩)।

প্রভাবশালী এসব দেশের কূটনীতিককে বাড়তি নিরাপত্তা তুলে নেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্তের পর কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বলেছিলেন, এতে দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নিয়ে নেতিবাচক প্রভাব দেখা দিতে পারে। যদিও উল্লিখিত দেশগুলোর পক্ষ থেকে প্রতিক্রিয়া দৃশ্যমান ছিল না। ১৫ মে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে উপপ্রধান মুখপাত্র কূটনীতিকদের নিরাপত্তায় ভিয়েনা কনভেনশন অনুসরণের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে আহ্বান জানান মাত্র। এদিকে ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী বিদেশি মিশন ও কূটনীতিকদের মৌলিক নিরাপত্তায় বাংলাদেশ কোনো আপস করবে না বলে পররাষ্ট্র সচিব নিশ্চিত করেন।

‘ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোমেটিক রিলেশন ১৯৬১’ অনুযায়ী জাতিসংঘের সদস্য যে কোনো দেশে অন্য কোনো দেশের কূটনৈতিক মিশন বা প্রতিনিধি অবস্থান করতে পারে এবং স্বাগতিক দেশ অন্য দেশের কূটনীতিকদের নিরাপত্তা, দপ্তর, বাসস্থানসহ নানা বিষয় নিশ্চিত করে থাকে। বাস্তবে বাংলাদেশে নিযুক্ত বিদেশি রাষ্ট্রদূতরা যে ধরনের সুবিধা পেয়ে থাকেন, বিদেশে নিযুক্ত বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূতরা সে সুবিধা পান না। পৃথিবীর কোনো দেশেই বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে বাড়তি নিরাপত্তা ও চলাচলের ক্ষেত্রে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের জন্য কোনো সুবিধা দেওয়া হয় না।

এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর সরকারি বাসভবন গণভবনে সাম্প্রতিক জাপান, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সফর নিয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বাংলাদেশের ওপর যারা নিষেধাজ্ঞা দেবে, সেসব দেশের কাছ থেকে কেনাকাটা না করার জন্য সরকারি ক্রয়বিধিতে নতুন ধারা যুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।’ (সমকাল, ১৬ মে ২০২৩)।

কূটনৈতিক অঙ্গনে পরপর তিনটি ঘটনায় পরিষ্কার– যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। কোনো একক ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধেও নয়। বাংলাদেশে বিএনপিসহ বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক দলগুলো যে নিষেধাজ্ঞার ভয় দেখিয়ে আসছিল, সেটা এর মধ্য দিয়ে অনেকটাই অসার প্রমাণ হয়েছে। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠিত কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের নেতারা তো প্রকাশ্যেই আমেরিকার ভয় দেখিয়ে আসছিলেন। কিন্তু তাঁরা যেটা খেয়াল করেননি, সেটা হচ্ছে, এই ভিসা নীতি বাংলাদেশ সরকার বা নির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে নয়। যাঁরাই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বাধাগ্রস্ত করবেন, তাঁদের জন্যই এটা প্রযোজ্য হবে। এখানে ক্ষমতাসীন দলের পাশাপাশি স্পষ্টভাবে বিরোধী রাজনীতিকদেরও কথা বলা হয়েছে। তার মানে, বিএনপি ও তার মিত্ররা আগের মতো জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন করতে পারবে না। নির্বাচন বয়কটের নামে নির্বাচন প্রতিরোধ করার সুযোগও আর নেই। সেদিক থেকে বিরোধী দলও যে খানিকটা চাপে পড়ে গেল, সেটা কি তারা ভেবে দেখেছে? নতুন ভিসা নীতি নিয়ে তাদের আত্মতুষ্টি অহেতুক।

বড় কথা, সরকারের পক্ষে যেভাবে নতুন ভিসা নীতিকে স্বাগত জানানো হয়েছে, তাতে কূটনৈতিক পরিপক্বতাই প্রকাশ পেয়েছে। ২৫ মে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে জানানো হয়– অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের লক্ষ্যে নতুন মার্কিন ভিসা নীতির বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিক্রিয়ায় তারা ‘খুশি’। (সমকাল, ২৭ মে ২০২৩)।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর ১৫ মে’র সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘সংকট আর ভয়ের কী আছে? বাংলাদেশ কারও ওপর নির্ভরশীল নয়।’ বস্তুত অর্থনীতি ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আমাদের দেশ এখন আর আগের মতো একক কারও প্রতি নির্ভরশীল নয়– এই বাস্তবতা বিশ্ববাসীও বোঝে।

অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী: প্রাক্তন উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়