- বাংলাদেশ
- বগুড়ায় বসিয়ে কর্মীদের বেতন দিচ্ছে বিটিসিএল
বগুড়ায় বসিয়ে কর্মীদের বেতন দিচ্ছে বিটিসিএল
টেলিকমিউনিকেশন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র

বগুড়ায় বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আছে। বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে নির্মাণ করা হয়েছে কয়েকটি সুসজ্জিত ভবন। আছে বাগান, রাস্তা ও থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থা। এর সবই এখন এতিমের মতো দাঁড়িয়ে আছে। কয়েক বছর ধরে এখানে কোনো কর্মকাণ্ড চলে না। কর্মকর্তা-কর্মচারীর কোলাহল নেই, হারিয়ে গেছে বাগান ও রাস্তার সৌন্দর্য। ভবনগুলো পরিণত হয়েছে আড্ডাখানায়, আবার রাতে মাদকসেবীদের মজমাও নাকি বসে! তবে নিয়োগকৃত সাত জনবলের জন্য নিয়মিত প্রতিবছর বেতন-ভাতা ও ব্যবস্থাপনা ব্যয় বাবদ দেওয়া হচ্ছে প্রায় অর্ধকোটি টাকা। এভাবে টানা বসিয়ে রেখেই ছয় বছরে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেছনে খরচ করা হয়েছে ৩ কোটি টাকার বেশি। অথচ প্রশিক্ষণ না পেয়ে কর্মদক্ষতার অভাবে কাজ করতে চরম অসহায়ত্ব বোধ করছেন টেকনিশিয়ানসহ বিটিসিএলের স্থানীয় জনবল।
জানা গেছে, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে বিটিসিএলে কর্মরতদের কারিগরি প্রশিক্ষণের জন্য বগুড়ার বনানী এলাকায় ১৯৭৯ সালে টেলিযোগাযোগ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি নির্মাণ করা হয়। ২৪ একর জায়গাজুড়ে প্রতিষ্ঠিত এই কেন্দ্রে একটি প্রশাসনিক ভবন, একটি প্রশিক্ষণ ভবন ও ছয়টি আবাসিক হোস্টেল তৈরি করা হয়। হোস্টেলে ৩৬টি সাধারণ কক্ষ ও চারটি ভিআইপি কক্ষ বানানো হয়। বৃহত্তর রাজশাহী বিভাগের টেলিযোগাযোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত টেকনিশিয়ানরা উন্নত প্রশিক্ষণ নিতেন এখান থেকে। অপটিক্যাল ফাইবার, সাবমেরিন কেবল, টেলিফোন অপারেটিংসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পেশাগত দক্ষতা বাড়ানোর জন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এখানে হাতে-কলমে শিক্ষা দেওয়া হতো।
দুই মাস মেয়াদের প্রশিক্ষণে প্রতি ব্যাচে ৩৫ থেকে ৪০ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হওয়ার পর থেকে জায়গাটি বেশ জমজমাট ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে ২০১০ সালের পর থেকে ধীরে ধীরে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম কমতে থাকে। আগে যেখানে বছরে কমপক্ষে চারটি ব্যাচে গড়ে ১৬০ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো, ২০১০ সাল থেকে বছরে মাত্র একটি করে ব্যাচকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হতে থাকে। ছয় বছর আগে একেবারেই বন্ধ হয়ে যায় সব কার্যক্রম। অর্থাৎ, ২০১৭ সালের পর আর কাউকে এখানে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি। এর পর থেকে এই কেন্দ্রে নিয়োগ করা জনবল অলস সময় পার করছে।
প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে কর্মরত কুক আবদুল আজিজ বলেন, হোস্টেলে রান্নাবান্নার জন্য আমি কুক হিসেবে নিয়োগ পাই। আবাসিক প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য প্রতিদিন খাবার তৈরি করতাম। কিন্তু এখন প্রশিক্ষণ নেই, রান্নার কাজও নেই। তবুও প্রতিদিন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে এসে তিন থেকে চার ঘণ্টা বসে থাকি আর ভাবি, আবার কবে কর্মচাঞ্চল্য জীবন ফিরে আসবে। নাকি এভাবে বসে বসেই অবশিষ্ট চাকরিজীবন কাটিয়ে দিতে হবে? তবে প্রতি মাসে ৪১ হাজার ৩০০ টাকা বেতন-ভাতা নিয়মিত পাচ্ছি। আমার আর পাঁচ থেকে ছয় বছর চাকরি আছে।
একই অবস্থার কথা জানান সেখানে কর্মরত চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী (প্রহরী) গোপাল গোস্বামী। তিনি বলেন, কাজ না থাকলেও প্রতিদিন যাতায়াত করি আর মাস শেষে বেতন-ভাতা উত্তোলন করি। কিন্তু কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখানকার ভবনগুলো অরক্ষিত হয়ে পড়ছে। প্রাচীরের কিছু অংশ ভেঙে ফেলেছে স্থানীয় দুর্বৃত্তরা। বখাটে ও মাদকসেবীরা রাতের বেলা আড্ডা দেয় বলে মাঝেমধ্যে শোনা যায়। এখন আমরাই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। আবার প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু হলে রাতারাতি সব ঠিক হয়ে যেতে পারে। এতে আমাদেরও আর বসে বসে বেতন খেতে হবে না।
এই কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়া বগুড়া টিঅ্যান্ডটিতে কর্মরত আবদুল মান্নান নামে টেকনিশিয়ান জানান, তিনি সেখান থেকে ২০১১ সালে প্রশিক্ষণ নিয়ে কর্মদক্ষতা বাড়িয়েছেন। ওই প্রশিক্ষণ তাঁর কর্মজীবনে অনেক সহায়ক হয়েছে। বর্তমানে সেখানে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম বন্ধ থাকায় নতুন নিয়োগ করা জনবল মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে সমস্যায় পড়ছেন।
টিঅ্যান্ডটিতে কর্মরত আবু বক্কর দাবি করেন, তিনি লাইনম্যান টেকনিশিয়ান হিসেবে কর্মরত। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো প্রশিক্ষণ তাঁর ভাগ্যে জোটেনি। বগুড়া প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য একাধিকবার আবেদনও করেছিলেন তিনি। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সেখানে কার্যক্রম বন্ধ আছে। তাই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না। নিয়োগের পর পূর্বাভিজ্ঞতা না থাকায় জ্যেষ্ঠ টেকনিশিয়ান আবদুল মান্নানের কাছ থেকে অনেক কাজ শিখেছি।
প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আলী বলেন, ২০১০ সালের আগে এখানে অনেকে প্রশিক্ষণ নিতে আসতেন। তখন এই এলাকা জমজমাট ছিল। কিন্তু ২০১৮ সাল কেউ প্রশিক্ষণ নিতে আসেননি। তাই সব কার্যক্রম বন্ধ আছে। এ জন্য অযত্ন-অবহেলায় আসবাবসহ অনেক মূল্যবান জিনিসপত্র নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কোটি কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে সরকারের। পুনরায় প্রশিক্ষণ চালু করলে বিটিসিএলের কর্মীরাও দক্ষতা বাড়াতে পারবেন আর আমাদের কর্মচাঞ্চল্য জীবন শুরু হবে।
মন্তব্য করুন