ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

ভয়ংকর চেহারায় ডেঙ্গু

ভয়ংকর চেহারায় ডেঙ্গু

তবিবুর রহমান

প্রকাশ: ৩১ মে ২০২৩ | ১৮:০০

দুই বছর আগে ২০২১ সালের মে মাসে সারাদেশে ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছিল মাত্র ৪৩ জন। গত বছরের মে মাসে এ সংখ্যা ছিল ১৬৩। এই বছরের মে মাসে রোগীর সংখ্যা ১ হাজার ৩৬। সরকারি পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে, কতটা আগ্রাসী চেহারায় রয়েছে এবারের ডেঙ্গু। আতঙ্কের বিষয়– গত বছরের চেয়ে এবার ছয় গুণ গতিতে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ বছর এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব বেশি। মে মাসের শুরুতে বৃষ্টি হওয়ায় জ্যামিতিক হারে রোগী বাড়ছে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় উড়ন্ত এডিস মশা নিধনের কর্মসূচি হাতে নেওয়া জরুরি বলে মনে করছেন তাঁরা।

এ পরিস্থিতে ডেঙ্গুর বিস্তার নিয়ন্ত্রণে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তবে অধিকাংশ হাসপাতালে রোগীর চিকিৎসায় রয়ে গেছে অব্যবস্থাপনা। এখনও অনেক হাসপাতালে প্রস্তুতিই নেওয়া হয়নি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ডেঙ্গু আক্রান্ত সব রোগীকে হাসপাতালের শয্যায় মশারির ব্যবস্থা রাখার নির্দেশ দিলেও চিকিৎসাধীন ৯০ শতাংশ রোগী থাকছেন মশারি ছাড়াই। এতে হাসপাতালের অন্য রোগীর মধ্যে ছড়াচ্ছে ডেঙ্গু। এছাড়া সব হাসপাতালে ডেঙ্গুর জন্য আলাদা ইউনিটও করা হয়নি।

চিকিৎসকরা বলছেন, ডেঙ্গু আক্রান্তদের হঠাৎ শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে। দ্রুতই হাসপাতালে নিতে হচ্ছে, গড়ে হাসপাতালে থাকতে হচ্ছে ৫ থেকে ৬ দিন। তবে হাসপাতালে গত বছরের মতো পরিস্থিতি এখনও তৈরি হয়নি। এদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে ডেঙ্গু চিকিৎসার বাড়তি খরচ মেটাতে বেকায়দায় পড়ছেন নিম্ন আয়ের অনেক মানুষ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, এ বছর (গতকাল পর্যন্ত) ২ হাজার ২২ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। এরমধ্যে মে মাসেই ১০৩৬ জন। জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত রোগী শনাক্ত হয়েছিল ৯৮৬ জন। সে হিসাবে গত চার মাসের চেয়ে মে মাসেই আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি। সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ দেখা গেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকার যাত্রাবাড়ীতে এবং রাজধানীর বাইরে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে।

রোগী ছয় গুণ
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সারাদেশে ৯ জন রোগী শনাক্ত হয়েছিল। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে এ সংখ্যা ছিল ২০ জন। এই ফেব্রুয়ারিতে রোগী বেড়ে ১৬৬ জনে দাঁড়ায়। মার্চেও একই গতিতে বেড়েছে ডেঙ্গু। ২০২১ সালের মার্চে ১৩ জন রোগী শনাক্ত হয়েছিল। গত বছর মার্চে ২০ জন। এ বছরের মার্চে রোগী বেড়ে হয় ১১১ জন। ২০২১ সালের এপ্রিলে মাত্র ৩ জন রোগী শনাক্ত হয়। গত বছর শনাক্ত হয়ছিল ২৩ জন। এই এপ্রিলে রোগী ছিল ১৪৩ জন। ২০২১ সালের মে মাসে ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল ৪৩ জন। গত বছর ছিল ১৬৩ জন। গত মে মাসে রোগী হাজার ছাড়িয়েছে। মে মাসে ডেঙ্গুতে দু’জনের মৃত্যু হয়। সব মিলিয়ে বছরের প্রথম পাঁচ মাসে মারা গেছেন ১৩ জন। ২০২২ সালে মারা গিয়েছিল ২৮১ জন, যা ২০ বছরের মধ্যে রেকর্ড মৃত্যু।

চিকিৎসায় অব্যবস্থাপনা
গত মঙ্গলবার সকাল ১০টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় আলাদা কোনো প্রস্তুতি নেই। হাসপাতালে রোগীদের জন্য মশারির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়নি। অন্য রোগীর সঙ্গে চলছে চিকিৎসা। শয্যা ফাঁকা না থাকায় অনেক রোগী মেঝেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
নতুন ভবনের ষষ্ঠ তলার ৬০২ নম্বর ওয়ার্ডের বারান্দার মেঝেতে সাত দিন ধরে ডেঙ্গুর চিকিৎসা নিচ্ছেন যাত্রাবাড়ীর সুমন মিয়া। হাসপাতাল থেকে তাঁকে দেওয়া হয়নি মশারি। শুধু পরীক্ষা-নিরীক্ষাতেই ২০ হাজার টাকার ওপরে খরচ হয়েছে তাঁর।

ওই ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন আলমগীর বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ৮ দিন আগে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি। শুরুতে প্রচণ্ড জ্বর, বমি, মাথা ব্যথাসহ বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দেয়। মুখে কোনো খাবার খেতে পারি না। পরীক্ষা করার পর ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে। এরইমধ্যে ১৫ হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছে। সরকারি হাসপাতালে যদি এত টাকা খরচ হয়, তাহলে আমার মতো নিম্ন আয়ের মানুষ কোথায় যাবে। তাঁর দাবি, আলাদা ইউনিটে চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা থাকলে ভালো হতো।

এদিকে ঢাকা মহানগর জেনারেল হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর ভর্তি নেওয়া হচ্ছে না। জটিল রোগী এলে মিটফোর্ড হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে। তবে সেখানেও ডেঙ্গুর আলাদা ইউনিট চালু হয়নি।
এ বছর সবচেয়ে বেশি রোগী মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। গত মঙ্গলবার দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ ডেঙ্গু রোগী যাত্রাবাড়ীর বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দা। ওই হাসপাতালের এক নার্স বলেন, যাত্রাবাড়ীতে এডিস মশার ঘনত্বের কারণে ওই এলাকার মানুষ বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। যাত্রাবাড়ী এলাকার এমন অনেক পরিবার আছে, যাদের দুই-তিনজন করে সদস্য আক্রান্ত হয়েছেন।

এছাড়া শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও ঢাকা শিশু হাসপাতালে গিয়েও ডেঙ্গু চিকিৎসার আলাদা কেনো প্রস্তুতি দেখা যায়নি।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক বলেন, এখনও আলাদা ইউনিটে চিকিৎসা দেওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। মশারি ছাড়া চিকিৎসার বিষয়টি অস্বীকার করে তিনি বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
মিটফোর্ড হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাজী রাশেদুন নবী বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশক্রমে সব কাজ সুন্দরভাবে পরিচালিত হচ্ছে। কোনো অব্যবস্থাপনা নেই।

মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মো. নিয়াতুজ্জামান বলেন, প্রতি বছর ডেঙ্গুর বড় ধাক্কাটা আমাদেরই সামলাতে হয়। এ কারণে আমরা প্রস্তুত রয়েছি। চিকিৎসাসেবায় কোনো ঘাটতি হচ্ছে না। যারা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন তাঁদের মধ্যে অনেকেই দ্বিতীয়বারের মতো ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। এ ধরনের রোগীরাই মূলত জটিলতা নিয়ে ভর্তি হচ্ছেন।

খরচ মেটাতে হিমশিম
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এ কঠিন সময়ে বাড়তি বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্তদের চিকিৎসা খরচ। সরকারি হাসপাতালে গড়ে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। বেসরকারিভাবে এ খরচ ৫০ হাজার টাকার ওপরে। ডেঙ্গু শনাক্তকরণে এনএস ১ অ্যান্টিজেন টেস্ট সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা নেওয়ার নির্দেশনা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দিলেও বেসরকারি হাসপাতালভেদে নেওয়া হচ্ছে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা।
ডেঙ্গু রোগী ও তাঁদের স্বজনরা জানান, পরীক্ষা-নিরীক্ষা খরচ অনেক বেশি। ভর্তির পর রোগীর শারীরিক অবস্থার ওপর নির্ভর করছে খরচের পরিমাণ। হাসপাতালে ভর্তি, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ওষুধ, শয্যা ভাড়া, পথ্যসহ খরচের ফর্দটা লম্বাই হতে থাকে। যাঁদের দীর্ঘদিন থাকতে হয় তাঁদের ব্যয় বাড়তেই থাকে। নিম্ন আয়ের মানুষের চিকিৎসার খরচ সামলাতে ধারদেনা করতে হচ্ছে।

জনস্বাস্থ্য বিশ্লেষকরা যা বলছেন
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ও সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, ডেঙ্গু রোগী এখন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ঢাকার বাইরে নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগও কম। যে কারণে রোগী বাড়ছে। আগামীতে ডেঙ্গু আরও ছড়ানোর শঙ্কা রয়েছে। এছাড়া ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগও কম। ডেঙ্গু প্রতিরোধে জাতীয় কর্মকৌশল প্রণয়ন জরুরি। একইসঙ্গে নিয়ন্ত্রণ সংস্থার সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং এ খাতে বাজেট বাড়াতে হবে। এ বিষয়ে কেউ কথা বলছে না।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, ডেঙ্গুর হটস্পট বা ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা সঠিক ব্যবস্থাপনার আওতায় না আনলে রোগী বাড়বেই। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় এডিস ভাইরাস বহনকারী উড়ান্ত মশা নিধন ও রোগীর চিকিৎসা ব্যবস্থায় মশারি যুক্ত করার ওপর জোর দেন এই বিশ্লেষক।

কী বলছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক আহমেদুল কবীর বলেন, গাণিতিক হারে রোগী বাড়া নিয়ন্ত্রণে সব সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগ স্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রতিটি হাসপাতালে নতুন নির্দেশনা দেওয়া আছে। স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ চলমান রয়েছে। ডেঙ্গু পরীক্ষার ফি সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা ও সরকারি হাসপাতালগুলোতে ১০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। নির্ধারিত অর্থের বেশি নিলে ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন তিনি। আহমেদুল কবীর আরও বলেন, ডেঙ্গু চিকিৎসায় আমরা সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন করে দিয়েছি। সেই গাইডলাইন অনুযায়ী সবাইকে চিকিৎসা দিতে হবে। প্লাটিলেট ব্যবহার নিয়েও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

দুই মেয়রের কার্যক্রম

ডেঙ্গুর প্রকোপকে অত্যন্ত অ্যালার্মিং বলেছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম। এ জন্য নগরবাসীকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। গতকাল বুধবার রাজধানীর কাওলা মধ্যপাড়া প্রধান সড়ক এলাকায় বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস উপলক্ষে শোভাযাত্রা এবং ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সচেতনতা প্রচারাভিযানে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, কিউলেক্স ও এডিস মশার উপদ্রব কমাতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। কোনো পাত্রে পানি জমিয়ে রাখা যাবে না।
এদিকে ডেঙ্গুকে সামাজিকভাবে প্রতিরোধ করতে হবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। তিনি বলেন, ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে আমরা সচেতনতামূলক গণলিফলেট বিতরণ কার্যক্রম নিয়েছি। আমরা ঘরে ঘরে এই লিফলেট পৌঁছে দিতে চাই। এর মাধ্যমে ডেঙ্গুকে আমরা প্রতিরোধ করতে চাই। কারণ শুধু কীটনাশক প্রয়োগ করে এডিস মশার বিস্তার রোধ করা সম্ভব নয়। গতকাল বাসাবো বৌদ্ধ মন্দিরসংলগ্ন সংঘনায়ক শুদ্ধানন্দ সড়কের নামফলক উন্মোচন, সড়ক উদ্বোধন এবং বৌদ্ধ মন্দির সংলগ্ন এলাকায় ডেঙ্গু প্রতিরোধে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে গণলিফলেট বিতরণ কর্মসূচির উদ্বোধন অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।







আরও পড়ুন

×