দলের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে নরসিংদীতে ‘বলি’ হলেন ছাত্রদলের দুই শীর্ষ নেতা। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও নরসিংদী জেলা আহ্বায়ক খায়রুল কবীর খোকন এবং জেলা সদস্য সচিব মঞ্জুর এলাহীর মধ্যে দীর্ঘদিন দলের ভেতর প্রভাব বিস্তারে চলা স্নায়ু লড়াই প্রকাশ্যে রূপ নিলে এ সংঘাতের ঘটনা ঘটে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিগত নির্বাচনে নরসিংদী-৩ (শিবপুর) আসনে বিএনপিদলীয় এমপি প্রার্থী ছিলেন জেলা বিএনপির বর্তমান সদস্য সচিব মঞ্জুর এলাহী। তবে দীর্ঘদিন ধরে তিনি নরসিংদী শহরে বসবাস করেন। এখন তিনি নরসিংদী-১ (সদর) আসনেই নির্বাচন করতে চান। অথচ এই আসনটিতে বিগত দুটি নির্বাচনেই দলীয় এমপি প্রার্থী ছিলেন খায়রুল কবীর খোকন।

একসময় জাতীয় পার্টি করতেন মঞ্জুর এলাহী। স্থানীয় রাজনীতিতে ডাকসুর সাবেক জিএস খায়রুল কবীর খোকনকে নরসিংদীর রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারে সুযোগ দিনে চান না প্রভাবশালী মঞ্জুর এলাহী। এ নিয়ে দু’নেতা নিজ নিজ বলয় শক্তিশালী করতে অঙ্গসংগঠনগুলোর কমিটি নিজেদের অনুসারীদের নেতৃত্বে গড়ার চেষ্টা করেন। এ নিয়ে দুই বলয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব-কোন্দল চরম আকার ধারণ করে। তবে প্রকাশ্যে গ্রুপিং ও কোন্দলের কথা স্বীকার করেন না দুই নেতা। অবশ্য মঞ্জুর এলাহীকে নেপথ্যে দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির একজন প্রভাবশালী নেতার সমর্থন রয়েছে বলে এলাকায় গুঞ্জন রয়েছে।

সর্বশেষ গত ২৫ মে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে প্রতিপক্ষের গুলিতে তাঁরা মৃত্যুবরণ করেন। এ ঘটনায় দু’পক্ষের শীর্ষ নেতাদের যেমন উস্কানি ছিল, তেমনি প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের ইন্ধনও ছিল বলে মনে করছেন জেলা বিএনপির ও ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা।

গত বৃহস্পতিবার জেলা বিএনপির কার্যালয় সংলগ্ন স্থানে পদবঞ্চিত মঞ্জুর এলাহীর অনুসারী ছাত্রদল নেতাদের মোটরসাইকেল শোভাযাত্রায় হামলা চালান খোকনের অনুসারীরা। এ সময় গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান জেলা ছাত্রদলের সাবেক জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সাদেকুর রহমান ও ছাত্রদল নেতা আশরাফুল ইসলাম।
অবশ্য দুই ছাত্রদল নেতা নিহত হওয়ার ঘটনায় এক নম্বর আসামি খায়রুল কবীর খোকন ও তাঁর স্ত্রী বিএনপি নেত্রী শিরিন সুলতানাকে দুই নম্বর আসামি করে ৪০ নেতাকর্মীর নামে মামলা করা হয়েছে। মামলার পর থেকে তাঁরা গা-ঢাকা দিয়েছেন।

এ বিষয়ে খায়রুল কবীর খোকনের মোবাইল নম্বরে বেশ কয়েকবার ফোন করলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়। নরসিংদী জেলা বিএনপির সদস্য সচিব মঞ্জুর এলাহী বলেন, বর্তমানে নরসিংদী জেলা বিএনপিতে কোনো কোন্দল নেই। খায়রুল কবীর খোকনের নেতৃত্বে সবাই ঐক্যবদ্ধ। ছাত্রদলের বিষয়টি সমাধান করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু কেন্দ্র যেখানে সিদ্ধান্ত দেয়, সেখানে তাঁদের আর কী বা করার থাকে।

গত ২৬ ফেব্রুয়ারি সিদ্দিকুর রহমান নাহিদকে ছাত্রদলের সভাপতি, মাইনুদ্দিন ভূঁইয়াকে সিনিয়র সহসভাপতি ও মেহেদী হাসানকে সাধারণ সম্পাদক করে জেলা ছাত্রদলের পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট (আংশিক) কমিটি অনুমোদন দেয় কেন্দ্রীয় ছাত্রদল। আগের কমিটির সদস্য সচিব মাঈনুদ্দিন ভূঁইয়াকে নতুন কমিটিতে সিনিয়র সহসভাপতি করা হলেও তাঁর প্রত্যাশিত পদ ছিল সাধারণ সম্পাদক। খায়রুল কবীর খোকন একচেটিয়াভাবে এ কমিটি বাগিয়ে নেন। এর পর থেকে ঘোষিত কমিটি বাতিলের দাবিতে পদবঞ্চিত ছাত্রদল নেতাকর্মীরা আন্দোলন চালিয়ে আসছিলেন। সেখানে মাঈনুদ্দিন ভূঁইয়াও সম্পৃক্ত হওয়ায় তাঁকে বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় ছাত্রদল। শুরুতে বিক্ষোভ মিছিল কর্মসূচি দিয়ে নতুন কমিটির বিরুদ্ধে অবস্থান ঘোষণা করেন পদবঞ্চিত নেতাকর্মীরা। একসময়ে তা সংঘর্ষে রূপ নেয়।

ঘটনার পরপর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক খায়রুল কবীর খোকনের বাড়ি ভাঙচুর, গুলি, অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটে। পদবঞ্চিত নেতাকর্মীরা বিদ্রোহ শুরু করলেও তাঁদের প্রশমিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি তখন। একচেটিয়াভাবে কমিটি বাগিয়ে নেওয়া, ত্যাগীদের কমিটিতে না রাখার ঘটনায় এ বিদ্রোহের শুরু। যদিও জেলা বিএনপির পক্ষ থেকে বিদ্রোহী নেতাকর্মীকে নিয়ে সমঝোতার চেষ্টা করা হয়।

জানা গেছে, একটি পক্ষের বাধায় তা সম্ভব হয়নি। সেখানে পদবঞ্চিতদের ক্ষোভে আরও ইন্ধন জুগিয়েছে, সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। বিপরীতে সংগঠনের নতুন কমিটির নেতারাও কিছু একটা করার তাগিদে বিদ্রোহীদের দমন করতে মাঠে নামেন। এর জের ধরে মারা যান নিজ দলেরই দু’জন ত্যাগী নেতা। যদিও ঘটনার দিন ছাত্রদলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক সাংগঠনিক কাজে ঢাকায় অবস্থান করছিলেন। সর্বশেষ গতকাল বুধবার আবারও খোকনের বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এতে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটে।
ছাত্রদল একাংশের নেতাকর্মীরা অভিযোগ করে বলেন, পদবঞ্চিত ছাত্রদল নেতারা বিএনপির মঞ্জুর এলাহীসহ কয়েকজন নেতার ইন্ধনে এবং স্থানীয় প্রশাসনের সমর্থন পেয়ে খায়রুল কবীর খোকনের বাড়িতে একের পর এক হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করেছে, অগ্নিসংযোগ করেছে। অথচ ভাঙচুরের ঘটনায় খোকনের পক্ষ থেকে থানায় একটি মামলাও নেওয়া হয়নি। এক অদৃশ্য কারণে পুলিশ নীরব থেকেছে। এ নিয়ে জনমনে উঠেছে নানা প্রশ্ন।

আবার নিহত ছাত্রদল নেতা সাদেকুর রহমান হত্যা মামলায় কে কে এবং কতজনকে আসামি করা হয়েছে, তা মামলার বাদী সাদেকুরের বড় ভাই আলতাফ হোসেন মেম্বার নিজেই জানেন না। তিনি সমকালকে জানান, ওসি তাঁকে কাগজ এনে স্বাক্ষর দিতে বলেছেন, তিনি দিয়েছেন। সেখানে কার নাম ছিল, আর কার ছিল না, তা তিনি জানেন না।

অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, মূলত জেলা বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জেরেই এ সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি। ২০২২ সালের ৩০ মে নরসিংদী জেলা বিএনপির নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়। সেখানে কেন্দ্রীয় বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবীর খোকনকে আহ্বায়ক ও মঞ্জুর এলাহীকে সদস্য সচিব করা হয়। সাবেক ছাত্রদল নেতা খায়রুল কবীর খোকন দীর্ঘ ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে এই জেলার নেতৃত্বে রয়েছেন। অন্যদিকে, মঞ্জুর এলাহী জাপা থেকে বিএনপিতে যোগদান করে গুরুত্বপূর্ণ এই পদে এসেছেন। ৬১ সদস্যবিশিষ্ট এ আহ্বায়ক কমিটিতে দলের অনেক ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাকে অবমূল্যায়ন করার অভিযোগ রয়েছে। এতে করে অভ্যন্তরীণ কোন্দল চরমে ওঠে।

জানা গেছে, খায়রুল কবীর খোকনের একক আধিপত্য বিস্তারের প্রবণতা থেকে জেলার অনেক ত্যাগী নেতা তাঁর কাছ থেকে দূরে সরে গেছেন। আগের কমিটির সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল মাস্টার থেকে শুরু করে প্রভাবশালী সুলতান মোল্লাসহ আরও অনেক নেতাকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করা হয়। সুলতান মোল্লার ছেলে আকরামুল হাসান কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। জেলা ছাত্রদলের আগের কমিটি আকরামেরও অনুসারী ছিলেন। একসময়ে তাঁরা খায়রুল কবীর খোকনেরও অনুসারী ছিলেন। কিন্তু তাঁরা বিগত আহ্বায়ক কমিটির নেতৃত্বে আসায় সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি খোকন। জেলার রাজনীতিতে প্রভাব ধরে রাখতে ছাত্রদলের নতুন কমিটির সুপার ফাইভের তাঁর অনুসারীদের নিয়েই গঠন করেন।

জেলা বিএনপি নেতা সারোয়ার হোসেন মৃধা বলেন, বিএনপির একজন কর্মী হিসেবে অভ্যন্তরীণ কোন্দলকে কোনো অবস্থায় সমর্থন করি না। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও সাবেক খাদ্যমন্ত্রী আব্দুল মোমেন খান হিন্দু অধুষ্যিত নরসিংদীকে বিএনপি ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত করে তোলেন, যা সাবেক এমপি শামসুদ্দিন আহমেদ এছাক পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। শামসুদ্দিন আহমেদ এছাকের মৃত্যুর পর যাঁরা বাইরে থেকে এসে নরসিংদীতে বিএনপির হাল ধরেছেন, তাঁরা শুরু থেকেই নোংরা রাজনীতি চর্চা করে বিএনপিকে আজ ধ্বংসের পথে এনে দাঁড় করিয়েছেন।

নরসিংদী জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক হারুন অর রশীদ বলেন, জেলা বিএনপিতে কার সঙ্গে কার দ্বন্দ্ব সেটাতে জড়াতে চাই না। তাঁর বাবা নরসিংদী সদর থেকে চার চারবারের নির্বাচিত এমপি শামসুদ্দিন এছাকের আদর্শকে বুকে ধরে বিএনপির রাজনীতিতে সম্পৃক্ত আছি।