- বাংলাদেশ
- কষ্টের কথাগুলি বল ‘আইজুদ্দীন’
কষ্টের কথাগুলি বল ‘আইজুদ্দীন’

একসময় ঢাকার দেয়ালে লেখা দেখা যেত, ‘কষ্টে আছি, আইজুদ্দীন’। এখন দেয়ালে না, বাজারে গেলে দেখা যায় কষ্টার্ত মানুষের মুখ। মুখের ভাঁজে ভাঁজে লেখা– ‘কষ্টে আছি’।
ঢাকাবাসী এক মধ্যবিত্ত মেধাবী লেখক-শিক্ষক ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন, ‘২টা করে ডিম খেতাম, এখন ১টা করে খাই। মুরগি খেলে ২ টুকরো খেতাম, এখন ১ টুকরো খাই। মাছ পুরো টুকরো খেতাম, এখন অর্ধেকটা খাই, সকালে বাজার করতাম, এখন রাতে করি; বাসে-টেম্পুতে অফিস যেতাম-ফিরতাম, এখন যাই কিন্তু ফিরি হেঁটে, রিকশা চড়ি না, মাসে মাসে ছেলেমেয়েদের মাটির ব্যাংকে টাকা দিতাম, এখন দিই না।’
এর মধ্যে সরকার বাজেট দিয়েছে। ব্যবসায়ীরা সারাবছর দাম বাড়ান, সরকার বাড়ান বাজেটের সময়। সুরম্য সংসদের মহতী সভায় সুললিত ভাষায় বাজেট পেশ করা হয়। সুন্দর পোশাক পরা অর্থমন্ত্রী তা পেশ করেন, দায়িত্বশীল মুখ করে সাংসদরা শোনেন। আমরা টিভিতে সব দেখি। শেষে খুব আন্তরিক আলোচনাও হয়। কিন্তু সেই বাজেট যে শুভঙ্করের ফাঁকি; তা কোথাও বলা হয় না। বলা হয় অল্প, করা হয় বেশি। যেমন এবার বলা হয়েছে বাসনপত্র, বাসমতী চাল, এলপিজি সিলিন্ডার, বিলাসী গাড়ি এসবের দাম বাড়বে। কিন্তু বলা হয়নি, মোটা চালের দাম সরকার না বাড়ালেও কেন বাড়তে বাড়তে ৬০-৭০ টাকায় ওঠে এবং আরও উঠবে। কারা বাড়ায় চাল-ডাল-ডিম-তেলসহ জীবনের জরুরি জিনিসগুলির দাম তা এক রহস্য। কাদের কৌশলে বাড়ি ভাড়া বাড়ে, চিকিৎসা খরচ মেটাতে ফতুর হয়ে যায় পরিবার।
সব দোষ সিন্ডিকেটের? মুক্তবাজার অর্থনীতির মহামান্য ভাশুর কি সিন্ডিকেট, তার নাম মুখে নেওয়া যায় না? আসল রহস্যটা এখানেই। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে আমদানিকারক আর পাইকারি বিক্রেতাদের হাতে লাগামছাড়া ক্ষমতা। অর্থনীতির যে চাবুকটা জনগণকে স্পর্শ করে, সেটা থাকে তাঁদের হাতে। অস্বাভাবিক ও অযৌক্তিক দাম বাড়ানোর মাধ্যমে তাঁরা মানুষের কষ্টের আয় লুট করে নিয়ে যান। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়। অথচ টাকার দাম কমে বলে একই বেতনে আগের মতো চলা যায় না। অর্থাৎ মজুরি-বেতন কমার এই কথা বাজেট বক্তৃতায় থাকে না। সরকারের পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ক’দিন আগেই জানিয়েছে, দেশের প্রতি তিন পরিবারের একটি ঋণগ্রস্ত।
সরকার লুট করে না। সরকার করে শোষণ। যেমন যারই একটা টিন সার্টিফিকেট আছে, তাঁকেই এই অর্থবছর থেকে ২ হাজার টাকা কর দিতে হবে। সরকারি ২০টি সেবা পেতে হলে টিন নম্বর নেওয়া বাধ্যতামূলক। সেবা পাওয়ার আশায় টিন নম্বর নিয়েছেন। এখন আপনাকে ২ হাজার টাকা কর দিতেই হবে। কোটি কোটি মানুষের কাছ থেকে ২ হাজার টাকা করে নিলে সরকারের বিরাট আয় হবে। সেই আয় দিয়ে তখন বিদ্যুৎ খাতের ভয়াবহ দুর্নীতি ও অনিয়মের খেসারত মেটানো যাবে। বিদ্যুৎ খাতে বরাদ্দ গত বছর ছিল ২৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। এবার করা হয়েছে ৩৪ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা। বাড়তি টাকা কে দেবে? অবশ্যই লোডশোডিংয়ের গণশাস্তিপ্রাপ্ত জনগণ দেবে। কোনো ব্যবসায়ী পণ্যের দাম এক লাফে ৫০ শতাংশ, অর্থাৎ দেড় গুণের মতো করার সাহস করেন না। কিন্তু আমাদের সরকার ডিজেল-পেট্রোলের দামে সেরকম ঐতিহাসিক রেকর্ড গড়েছে। বিদ্যুতের দাম যে এত বাড়ছে, ওয়াসার সাত লাখ টাকা বেতনের এমডি পানির দাম যে আবারও বাড়াবেন, সেসব কথা তো বাজেটে নেই। বাজেটে বলা হয় না, বেসরকারি চিকিৎসা খরচ, পরিবহন ভাড়া ইচ্ছামতো বাড়বে।
করোনার মহাবিপর্যয়ের পরও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর কথা ছিল। কিন্তু ৫.৪ শতাংশ থেকে হয়েছে ৫ শতাংশ। খাদ্য, শিক্ষা, কৃষি খাতের মতো গণমুখী জায়গায় বরাদ্দ বেড়েছে ১ হাজার কোটি থেকে ২ হাজার কোটি টাকা করে। আসলে বাড়েনি। মূল্যস্ফীতি হিসাব করলে দেখা যাবে, বর্ধিত টাকা দিয়েও আগের সেবা দেওয়া কঠিন হবে। সবচেয়ে করুণ হলো, সামাজিক সেবা খাতে। বয়স্ক ভাতা ৫০০ টাকার জায়গায় হয়েছে ৬০০ টাকা, বিধবা ভাতা বেড়েছে মাত্র ৫০, কিন্তু গরুর মাংসের দামই বেড়েছে কেজিপ্রতি ৩০০ টাকা!
প্রতিবছর বাজেটের আকার বাড়ে। বাড়তি টাকা কোথায় যায়? দুটি হিসাব দিয়ে শেষ করি। দেশের বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে যে জাতীয় গ্রিডে এক ইউনিট বিদ্যুতের জোগান না দিয়েও বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের দেশি ও বিদেশি মালিকদের ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ তিন বছরে দেওয়া হয়েছে ৫৪ হাজার কোটি টাকা! বছরে মুদ্রা পাচার হয় ৭.৫৩ বিলিয়ন ডলার (সূত্র: জিএফএই) । আর ২০২৩-২৪ সালে জাতীয় বাজেট হলো ৬৩ বিলিয়ন ডলার বা ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। কয়েক হাজার লোকের এক বছরের মুদ্রা পাচারের মাত্র আট গুণ বেশি ১৮ কোটি মানুষের বাজেট!
সবকিছু বাজেটে থাকে না। একজন লিখেছেন, আগে শুক্রবারে পাড়ার মোড়ে চারটা গরু জবাই হতো, এখনও হয়। আমার মতো অনেকে যায় না, কিন্তু সবই বিক্রি হয়ে যায়। অনেকে অভাবের খাদে পড়ছে, কিন্তু কেউ কেউ উঠে যাচ্ছে। যিনি আগে কলাবাগান থাকতেন, তিনি চলে যাচ্ছেন রাজউকের সীমানার বাইরে। যিনি পরিবার নিয়ে ফ্ল্যাটে থাকতেন, তিনি নিচ্ছেন সাবলেট। যিনি তাও পারছেন না, তিনি পরিবারকে পাঠিয়ে দিচ্ছেন গ্রামে। শুধু বলতে ইচ্ছা করে, আমরা কেমন করে বেঁচে আছি, তুই সেই কষ্টের কথা বল আইজুদ্দীন।
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সমকালের পরিকল্পনা সম্পাদক।
farukwasif0@gmail.com
মন্তব্য করুন