- বাংলাদেশ
- দুর্বিষহ রাত মনে পড়লে আঁতকে ওঠেন স্বজন
দুর্বিষহ রাত মনে পড়লে আঁতকে ওঠেন স্বজন

‘রাস্তার পাশেই আমার ফলের দোকান। আম সাজানো শেষ করে তাল কাটছিলাম। আমার সাত বছরের ছেলে দোকানে বসে ঘুমিয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ একটা বিকট শব্দ আসে। ছেলে দু’বার চিৎকার করার পরই কয়লার মতো হয়ে গেল। আমি কীভাবে বেঁচে গিয়েছিলাম, জানি না। সেটা আমাদের কালরাত। সেই ভয়াবহ আগুনের কথা মনে পড়লে আতঙ্কিত হই এখনও। তাই মনে করতে চাই না।’ পুরান ঢাকার নিমতলীর সেই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে এভাবেই বললেন ফল ব্যবসায়ী মামুন মিয়া। ওই আগুনে তাঁর সাত বছরের ছেলে প্রাণ হারিয়েছে।
১৩ বছর আগে আজকের দিনে পুরান ঢাকার নিমতলীতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। রাসায়নিক গুদাম থেকে এই আগুন লাগে।
এতে প্রাণ হারান ১২৪ জন। দগ্ধ ও আহত হয়েছিলেন কয়েকশ মানুষ। সে সময় বংশাল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি হলেও তদন্ত হয়নি। এদিকে পুরান ঢাকা থেকে বারবার রাসায়নিক গুদাম সরানোর কথা বলা হলেও কার্যকর হয়নি সেভাবে। বিভিন্ন অলিগলির বাসাবাড়িতে এখনও বহাল তবিয়তে রয়েছে রাসায়নিকের গুদাম।
ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের লোকজন বলছেন, বছর ঘুরে দিনটি এলেই মানুষের মনে পড়ে সেই ট্র্যাজেডির দিনের কথা। খোঁজখবর নিতে সবাই আসেন। আর সারা বছর খোঁজ থাকে না কারও।
নবাব কাটারার যে ভবনে আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল, তার পাশের দোতলা বাড়িতেও আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল। ওই বাড়ির ৯ বাসিন্দা প্রাণ হারিয়েছিলেন। বাড়িটির মালিক মো. জুয়েল গতকাল সমকালকে জানান, সেই রাতের আগুনে তাঁর মা-বাবা, ফুফু-ফুফা, ফুফাতো দুই বোন এবং গৃহকর্মী ও দুই ভাড়াটিয়া মারা যান।
আগুনের আগে তিনি এশার নামাজ পড়তে মসজিদে গিয়েছিলেন। মসজিদে বসেই আগুন লাগার খবর পেয়েছিলেন। ছুটে গিয়ে আর নিজের বাড়িতে ঢুকতে পারেননি। দূর থেকে চিৎকার করেছেন শুধু। পরদিন ভোরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পরনের লুঙ্গি দেখে বাবার মরদেহ শনাক্ত করেন তিনি। মায়ের মরদেহ শনাক্ত করেন সকালে মিটফোর্ড কলেজ মর্গে। তিনি বলেন, ‘খুব কষ্টে দিন পার করেছি। আড়াই বছর বাড়িতে ছিলাম না। এখন কষ্টটা একটু কাটিয়ে উঠছি। সেই বাড়িতেই বাস করছি। আগুন আমাকে এতিম করে দিয়েছে। সেই আগুনের ভয়াবহ দিনের কথা আর মনে করতে চাই না। এর পরও সেই স্মৃতি ভেসে ওঠে।’ তিনি জানান, আজ বাদ আসর নবাব কাটারা মসজিদে মিলাদ মাহফিল হবে। ঘটনাস্থলের পাশে মৃতদের স্মরণে নির্মাণ করা বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হবে।
২০১০ সালের ৩ জুন রাতে নিমতলীর নবাব কাটারা এলাকার পাঁচতলা ভবনে আগুন লাগে। ভবনটিতে ছিল রাসায়নিকের গুদাম। এ কারণে ভয়াবহ আগুন ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের এলাকায়। সেই আগুনে দুই বোন উম্মে ফারুয়া রুনা ও সাকিনা আক্তার রত্না মা-ভাইসহ সাতজন নিকটাত্মীয় আগুনে প্রাণ হারিয়েছিলেন। সেই রাতে নিমতলীর বাসায় বাগদান হওয়ার কথা ছিল রুনার। বরপক্ষের লোকজন চলে এসেছিলেন তাঁদের বাসায়। আগুনে বরপক্ষের পরিবারেরও সাতজনের মৃত্যু হয়। তাঁর ছোট বোন রত্নারও বিয়ের দিন ঠিক করা ছিল একই মাসের ১৯ তারিখে। আগুন লাগার কিছুক্ষণ আগে দুই বোন রূপসজ্জার জন্য পার্লারে যাওয়ায় বেঁচেছিলেন। তাঁদের প্রতিবেশী আসমা আক্তার শান্তারও ঘটনার পাঁচ দিন পর বিয়ের দিন ধার্য ছিল। কিন্তু আগুনে প্রাণ হারান শান্তার মা, খালা ও ভাতিজি। দগ্ধ হন কয়েকজন স্বজন। দুটি পরিবারে তিনকন্যার বিয়ের বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। পরে তাঁদের দায়িত্ব নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নিজের কন্যা হিসেবে ঘোষণা দিয়ে গণভবনে আগের ঠিক সেই পাত্রদের সঙ্গে তাঁদের বিয়ে দেন তিনি। তিনজনের স্বামীকে নিজের মেয়েজামাই আদরে যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি দিয়েছেন। তিন কন্যাকে রাজধানীতে ফ্ল্যাটও বরাদ্দ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
বংশাল থানায় একটি জিডি করে তৎকালীন জেলা প্রশাসকের নির্দেশে মৃতদেহ হস্তান্তর করা হয়েছিল স্বজনের কাছে। সেই জিডির তদন্ত আর এগোয়নি।
জিডির তদন্তে অগ্রগতি হিসেবে জানতে চাইলে বংশাল থানার ওসি মজিবুর রহমান জানান, ঘটনা অনেক আগের। সে বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না।
মন্তব্য করুন