- বাংলাদেশ
- মানুষের চাওয়া পূরণের ভাবনা বাজেটে নেই
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংলাপ
মানুষের চাওয়া পূরণের ভাবনা বাজেটে নেই

এ মুহূর্তে মানুষ কী চায়, তাদের কী অভাব এবং কীভাবে তা দূর করা যাবে– এমন ভাবনা থেকে জাতীয় বাজেট করা হয়নি। প্রশ্ন হলো, মানুষ কী চায়। তারা চায়, ব্যবসা ও কাজের ক্ষেত্রে যেসব বাধা আছে, সরকার দূর করে দিক। বাকিটা তারা করে নেবে। বাজেটের আগে-পরে নানাজন নানা পর্যায় থেকে আলোচনা ও চুলচেরা বিশ্লেষণ করেন, যার কিছুই আমলে নেওয়া হয় না। এমনকি সংসদেও আলোচনা হয় না। ওপরের দু-চারজনের কিছু সুপারিশ মেনে সামান্য কিছু পরিবর্তন করে ‘হ্যাঁ’ জয়যুক্ত হয়েছে জানানোর মাধ্যমে পেশ করা বাজেটই পাস হয়ে যায়। এবারও তা-ই হবে।
গতকাল শনিবার ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস অ্যান্ড ইকোনমিক ফোরাম আয়োজিত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট পেশ-পরবর্তী সংলাপে এসব কথা বলেন বিশেষজ্ঞরা। রাজধানীর মহাখালীতে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত সংলাপে বক্তা ছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইপিডিসির সিইও মমিনুল ইসলাম এবং চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট স্নেহাশীষ বড়ুয়া। সঞ্চালনা করেন ব্র্যাক বিজনেস স্কুলের সিনিয়র প্রভাষক তানিয়া আকতার।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বাজেট যদি দেশের মানুষের কল্যাণে হয়, তাহলে এ বিষয়ে মানুষের কথা শোনা উচিত। বাজেট ঘোষণার দুই থেকে তিন মাস আগেই সম্ভাব্য বাজেটের রূপরেখা প্রকাশ করা উচিত। এর পর সব মহলের পরামর্শ দিয়ে সরকার বাজেট প্রস্তাব চূড়ান্ত করতে পারে।
তিনি বলেন, জাতীয় বাজেট কেবল সংখ্যা বা সরকারের আয়-ব্যয়ের খতিয়ান নয়। এটি এমন একটি মূল্যবান দলিল, যা দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং ব্যক্তি মানুষের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডে প্রভাব ফেলে। এমন বাস্তবতায় অনেকে পছন্দ না করলেও তিনি কিছু কথা বলেন; বাজেটের দুর্বল ও চ্যালেঞ্জের দিকগুলো তুলে ধরেন, যাতে ভালোভাবে বাস্তবায়ন করা যায়। তিনি আরও বলেন, দেশে দুর্নীতি ও অর্থ পাচার বন্ধ হচ্ছে না। দেশে কাঙ্ক্ষিত কর্মসংস্থান হচ্ছে না, মজুরি বাড়ছে না।
বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা সাড়ে ৭ শতাংশ ধরা হয়েছে। কিন্তু কোথা থেকে প্রবৃদ্ধি হবে, কৃষির উৎপাদন কি তিন গুণ হয়ে যাবে– এমন প্রশ্ন রেখে ড. সালেহউদ্দিন বলেন, এটা স্রেফ একটা সংখ্যা নয় যে চাইলেই অর্জন সম্ভব। সরকারের উদ্দেশে তিনি প্রশ্ন রাখেন, উৎপাদন কোথায় বাড়াবেন। গাড়ি ভাড়া চার গুণ করে দেবেন, নাকি সুন্দরবন বিক্রি করে ৫০ থেকে ১০০ বিলিয়ন আয় করবেন? এসব জগাখিচুড়ি অঙ্কের হিসাবের বাজেট দিলে তো হবে না। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ অর্জন হলেও তা অনেক।
সাবেক গভর্নরের মতে, বাজেটের বিশাল রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য অর্জনে বেসরকারি পর্যায়ে কর এজেন্ট নিয়োগের পরিকল্পনা মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হয়রানি সৃষ্টির নতুন দ্বার খুলবে। রাজস্ব বাড়াতে এনবিআর কত কত গবেষণা ও জরিপ করছে, কাজ কিছুই হচ্ছে না। বলছে, জনবল নেই। এখন যে রাজস্ব আসে, তার সিংহভাগই স্বয়ংক্রিয়ভাবে উৎসে কর্তন থেকে। এখানে এনবিআরকে কিছু করতে হয় না।
মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ঘোষিত বাজেটে যে ঘাটতি প্রাক্কলন করা হয়েছে, তা থাকবে না। কারণ বাজেটে যে উন্নয়ন ব্যয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে, তা বাস্তবায়িত হবে না।
এ বাজেটের বড় চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে এ হার এখনও ৯ শতাংশের ওপর। বলা হয়েছে, এটি ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে। কিন্তু কীভাবে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা হবে, তার দিকনির্দেশনা নেই। মূল্যস্ফীতির চাপ সামাল দিতে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা ও বরাদ্দ বাড়ানোর দরকার ছিল। যাঁদের প্রকৃতই সহায়তা দরকার, তাঁদের চিহ্নিত করে সহায়তা প্রদান নিশ্চিত করা দরকার। কারণ এখনও এমন লোক এ সুবিধা পান, যাঁদের দরকার নেই।
তিনি বলেন, বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকারের ব্যাংক নির্ভরতা বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ কমাবে। এরই মধ্যে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমেছে। শেয়ারবাজারও কার্যকর নয়। অথচ বাজেট অনুযায়ী বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ ২২ দশমিক ৮ থেকে ২৭ দশমিক ৪০ শতাংশ হবে। এটা কী করে সম্ভব, বোধগম্য নয়।
আইপিডিসির সিইও বলেন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এখন বড় চাহিদা। অথচ শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দ মাত্র ৩৪৭ কোটি টাকা। রেমিট্যান্স পাঠিয়ে যে মানুষগুলো দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখছে, সেই প্রবাসী মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ এক হাজার কোটি টাকা। আমাদের বরাদ্দ বেশি পরিচালন ব্যয়ে, বড় প্রকল্পে। খরচে স্বচ্ছতা থাকতে হবে। তার জন্য সুশাসন ও জবাবদিহিও লাগবে।
দেশের বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র পায়রা আজ রোববার থেকে কয়লার অভাবে বন্ধ হয়ে যাবে উল্লেখ করে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট স্নেহাশীষ বড়ুয়া বলেন, তাহলে শিল্পের উৎপাদন কীভাবে হবে, রাজস্ব কোথা থেকে আসবে? কর আদায় বাড়াতে সরকার নতুন কর আইন করছে। কিন্তু যত আইনই হোক, ডিজিটাইজেশন ছাড়া সুফল মিলবে না। বেসরকারি কর এজেন্ট নিয়োগের মাধ্যমে এনবিআর করদাতাদের রিটার্ন দাখিলে সহায়তা করতে চায়। তবে বাংলাদেশের যে বাস্তবতা, তাতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষকে হয়রানি করা হবে না– এমন নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না।
বাজেটকে যৌক্তিকভাবে প্রণয়নের পরামর্শ দিয়ে বক্তারা আরও বলেন, ব্রিজ আছে অথচ সংযোগ রাস্তা নেই– এমন প্রকল্পের এখন দরকার নেই। কাজ করুক বা না করুক, ঠিকাদারকে টাকা দিতে পারলেই বুঝি প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়ে গেল– এ ধারা ভাঙতে হবে। সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত না করার পরামর্শ দিয়ে বলেন, গরিব মানুষ শেয়ারবাজারেও যেতে পারে না। আবার ভালো ও নিরাপদ বিনিয়োগ করতে না পারলে জাতীয় সঞ্চয় কমবে।
মন্তব্য করুন