- বাংলাদেশ
- চাকিরপশার নদী উদ্ধার হউক
চাকিরপশার নদী উদ্ধার হউক
নদীসহ বিভিন্ন জলাশয় ধ্বংসের ক্ষেত্রে নগর ও গ্রামাঞ্চলের পার্থক্য যে প্রায় ঘুচিয়া যাইতেছে– শনিবারের সমকাল উহার সাক্ষ্য দিয়াছে। ঐ দিন প্রকাশিত দুইটি সংবাদসূত্রে জানা যাইতেছে, কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলায় যেইভাবে চাকিরপশার নদী, একইভাবে খোদ রাজধানীর গেণ্ডারিয়ায় ডিআইটির পুকুর দখল হইতেছে। স্বীকার করিতে হইবে অবশ্য; কুড়িগ্রামের নদীটির দখল প্রক্রিয়া কয়েক কাঠি সরেস। একটি প্রাকৃতিক প্রবাহে বেআইনিভাবে বাঁধ দিয়া কী প্রকারে পুকুরে রূপান্তর এবং বৎসরের পর বৎসর ভোগদখল করিতে হয়; উহার অনন্য উদাহরণ হইতে পারে নদীটি।
সমকালের প্রতিবেদনে স্থানীয়দের বরাতে বলা হইয়াছে, এক সময় চাকিরপশার নদীর প্রস্থ ছিল প্রায় এক কিলোমিটার, দৈর্ঘ্য ৫০ কিলোমিটার। আশির দশকে দখলদারদের দৌরাত্ম্যে নদীটির বুকে নির্মিত হয় সড়ক। তৎসহিত নদীতে বাঁধ দিয়া চলে পুকুর তৈরির প্রতিযোগিতা। ফলস্বরূপ, সিএস-মূলে প্রাপ্ত নদীটির ৩০৬ একর সরকারি জমির ২৬৯ দশমিক ৭২ একর ইতোমধ্যে বিভিন্ন ব্যক্তির নামে রেকর্ড হইয়াছে। শুধু উহাই নহে, অবৈধ উপায়ে অর্জিত এই জমি বন্ধক রাখিয়া একজন দখলদার একটি সরকারি ব্যাংক হইতে ঋণও গ্রহণ করিয়াছেন। এমনকি ঐ বন্ধকি জমি সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের অগোচরে পুনরায় অন্যজনের নিকট বিক্রয়ও করা হইয়াছে। লক্ষণীয়, এই সকল অপকর্ম সংঘটিত হইয়াছে সরকারি সম্পত্তি রক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাসমূহের নাসিকার অগ্রভাগে। কিন্তু অদ্যাবধি উহা উদ্ধারে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ উহারা গ্রহণ করা হয় নাই।
ইহা সত্য, সমকালসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এ সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশের পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছর চাকিরপশার নদীর ইজারা বিজ্ঞপ্তি স্থগিত করা হইয়াছে। সর্বশেষ গত মার্চে ১৪১ একর জলাশয় উন্মুক্ত বলিয়াও ঘোষণা করা হয়। বাস্তবে ঐ ঘোষণা কাগজেই সীমাবদ্ধ; প্রভাবশালীদের দৌরাত্ম্যে জেলেরা নদীতে নামিতে পারিতেছে না। যদিও দেশের আইন উন্মুক্ত ঘোষিত সকল জলাশয়ে মৎস্য আহরণের অধিকার জেলেদের দিয়াছে। প্রতিবেদন অনুসারে, চাকিরপশার নদীর দখলদারদের মধ্যে অন্যতম জেলার রাজারহাট উপজেলা কৃষক লীগের সাবেক সভাপতি ইউনুস আলী, যাহার দখলে রহিয়াছে ৩৪ একর জমি। এই তথ্যই বলিয়া দেয়, নদীটি সুরক্ষায় আন্দোলনকারীরা কেন দুদকসহ একাধিক সরকারি সংস্থার নিকট লিখিতভাবে প্রতিকার প্রার্থনা করিবার পরও পরিস্থিতি এখনও তথৈবচ। দখলদারদের সহিত প্রশাসনের নীতিহীন অংশের অশুভ আঁতাতের কারণেই যে দেশের সংবিধান, আইন এবং উচ্চ আদালতের রায় উপেক্ষা করিয়া নদীটির জমি শ্রেণি পরিবর্তনের মাধ্যমে ব্যক্তিমালিকানায় দেওয়া হইয়াছে– উহা বুঝিবার জন্য বিশেষজ্ঞ হইবার প্রয়োজন নাই।
অধিকতর উদ্বেগজনক, এহেন সম্পূর্ণ একটা নদী গ্রাস করিবার আয়োজন শুধু কুড়িগ্রামেই নহে, দেশের অন্যত্রও চলমান। গত ২২ মে সমকালেই এক প্রতিবেদন প্রকাশিত হইয়াছিল; যথায় স্থানীয় প্রশাসনের উদাসীনতায় এক প্রভাবশালী ‘রাজা’ কর্তৃক হবিগঞ্জের শুটকি নদীর মালিক বনিয়া যাইবার কাহিনি তুলিয়া ধরা হয়। এমনকি খোদ রাজধানীতেও, যথায় দেশের সকল প্রশাসনিক প্রধানের বসবাস ও কর্মস্থল– জলাশয় ও সবুজ উধাও হইয়া ক্রমশ। রবিবার সমকালের এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স-বিআইপির সাম্প্রতিক এক গবেষণার বরাত দিয়া লিখা হইয়াছে, ১৯৯৫ সালে রাজধানীতে জলাধার ও জলাভূমি ৩০ বর্গকিলোমিটারের অধিক থাকিলেও বর্তমানে কমবেশি মাত্র ৪ বর্গকিলোমিটার। একটি আদর্শ শহরে ন্যূনতম ১২ শতাংশ জলাভূমি ও ১৫ শতাংশ এলাকায় সবুজ থাকা বাঞ্ছনীয় হইলেও বর্তমানে রাজধানীতে ৩ শতাংশেরও কম জলাধার এবং মাত্র ৭ শতাংশ সবুজ রহিয়াছে। এই বিলুপ্ত জলাশয় ও সবুজ একটা অপরিকল্পিত উন্নয়নের ভোগে লাগিলেও বড় অংশ স্পষ্টতই দখলদারিত্বের শিকার।
এই নদী-জলাশয় দখল, তৎসহিত সবুজ বিনষ্টের ধ্বংসাত্মক আয়োজন আর চলিতে দেওয়া যায় না। কারণ প্রকৃতিবিনাশী এহেন তৎপরতার কারণে ইতোমধ্যে বিশ্বের বসবাসের জন্য নিকৃষ্টতম শহরগুলির তালিকায় ঢাকার নাম উঠিয়াছে। এই ধারা অব্যাহত থাকিলে এক সময় দেশটাই বসবাসের অযোগ্য হইয়া পড়িবে। তাই অবিলম্বে দখলকৃত সকল নদী-জলাশয়ের প্রবাহ ফিরাইতে, তৎসহিত প্রকৃতি ধ্বংসের সকল আয়োজন বন্ধে উদ্যোগী হওয়া জরুরি। এই মহৎ কর্ম চাকিরপশার নদীর দখলদার উচ্ছেদের মধ্য দিয়াই সূচিত হউক।
মন্তব্য করুন