মানুষ বা প্রাণীর মতো নদীও আইনি অধিকার পাবে। নদীর যে কোনো ক্ষতির বিরুদ্ধে যাওয়া যাবে আদালতেও। নদীকে ব্যক্তি আইনি সত্তা বা জীবন্ত সত্তার স্বীকৃতি দিয়ে ২০১৯ সালে এমনই এক রায় দিয়েছিলেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত।

অথচ বছরজুড়ে ৫৬ নদীর নমুনা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর গত ১৪ মার্চ বেসরকারি সংস্থা রিভার অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৫৬ নদীর সবকটি অতিমাত্রায় দূষিত। এর মধ্যে শিল্পকারখানার বর্জ্যের কারণে গাজীপুরের লবণদহ, নরসিংদীর হাঁড়িধোয়া ও হবিগঞ্জের সুতাং নদীর অবস্থা সবচেয়ে ভয়াবহ।

দেশের নদনদীর এই যখন হাল, তখন পরিবেশ আদালতের চিত্র বলছে, পরিবেশ-সংক্রান্ত নির্দিষ্ট আদালতে পর্যাপ্ত মামলা না থাকায় সেখানে অন্য আইনে করা মামলার বিচার চলছে। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, পরিবেশ সুরক্ষায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের উদাসীনতার পাশাপাশি দায় রয়েছে সরকারেরও।

পরিবেশ আইন ২০০০ অনুযায়ী, সব জেলায় পরিবেশ আদালত গঠনের বিধান থাকলেও আছে শুধু ঢাকা ও চট্টগ্রামে। এ দুই আদালতের দেওয়া রায় বা আদেশের আপিল নিষ্পত্তির জন্য ঢাকায় আছে একটি পরিবেশ আপিল আদালত।

এসব আদালতে কেউ চাইলেই আবার মামলা করতে পারেন না। তবে আইনের শর্তসাপেক্ষে পরিবেশ-সংক্রান্ত ক্ষতিপূরণের বিষয়ে পরিবেশ আদালতে দাবি উত্থাপনের সুযোগ রয়েছে।

পরিবেশ আইন অনুযায়ী মামলা করতে হলে অভিযোগকারীকে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) বরাবর আবেদন করতে হয়। ডিজি তদন্ত করে যদি অভিযোগের বিষয়ে অনুমোদন দেন, তবেই তিনি আইনের আওতায় মামলা করতে পারেন। এ কারণে সাধারণ মানুষ পরিবেশ-সংক্রান্ত মামলা করার ব্যাপারে উৎসাহ হারান।

এ ব্যাপারে বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহ্‌দীন মালিক সমকালকে বলেন, ‘পরিবেশ আইনটি নাগরিকবান্ধব নয়। কারণ, এখানে নাগরিককে সরাসরি মামলা করার সুযোগ দেওয়া হয়নি। অথচ পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরিবেশদূষণের বিরুদ্ধে যদি সরকার কঠোর অবস্থান নিতে চায়, তাহলে আইন সংশোধন করে নাগরিককে সরাসরি মামলা করার সুযোগ দিতে হবে।’

সুপ্রিম কোর্টের তথ্যানুযায়ী, সব মিলিয়ে তিনটি পরিবেশ আদালতে বর্তমানে ৩৬৫ মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে ঢাকায় ১১৩ ও চট্টগ্রামে রয়েছে ২৪৩ মামলা। পরিবেশ আপিল আদালতে বিচারাধীন ৯টি মামলা। পরিবেশ-সংক্রান্ত মামলার সংখ্যা কম থাকায় ঢাকা ও চট্টগ্রামের ওই দুটি পরিবেশ আদালতে অন্য আইনে করা মামলারও বিচার চলছে। প্রায় আড়াই হাজার মামলা বিচারাধীন ওই দুই আদালতে।

পরিবেশ আদালত ছাড়াও স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত পরিবেশ-সংক্রান্ত মামলার বিচার করে। পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী দেশের আট বিভাগীয় স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বর্তমানে বিচারাধীন ৬৬৯ মামলা। অন্যদিকে উচ্চ আদালতে পরিবেশ-সংক্রান্ত ১ হাজার ৩৫৪টি রিট বিচারাধীন। অবশ্য বিচারিক আদালতের বাইরে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকেও ভ্রাম্যমাণ (মোবাইল) আদালতের মাধ্যমে পরিবেশ সুরক্ষায় অভিযোগ নিষ্পত্তি করা হয়। তবে এসব উদ্যোগের পরও পরিবেশদূষণ কোনোভাবেই কমছে না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পরিবেশ অধিদপ্তরে এমনিতেই নাগরিকের অভিযোগের সংখ্যা কম। এর মধ্যে যেসব অভিযোগ জমা পড়ে, তা যাচাই-বাছাই করে আদালতে পাঠানো হয়। এর সংখ্যা আরও কম। এ-সংক্রান্ত গত ফেব্রুয়ারির একটি প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ওই মাসে পরিবেশ আদালতে ১৭ মামলা নথিভুক্ত হয়েছে।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সমকালকে বলেন, ‘পরিবেশ আদালতে মামলা না হওয়ার কয়েকটি কারণ আছে। এর মধ্যে প্রধান কারণ, এই আদালতের এখতিয়ার স্পষ্ট নয়। এই আদালতকে শুধু পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের আওতায় দায়ের হওয়া মামলা বিচার করার এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে। ফলে অনেক অপরাধ এই আদালতের এখতিয়ারের বাইরে থাকে। দ্বিতীয়ত, এখানে মামলা করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তরকে। এ ক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তর মামলা করার ক্ষেত্রে আগ্রহ দেখায় না।  কারণ, মামলা করতে হলে অধিদপ্তরের ব্যর্থতাকেই স্বীকার করতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘অধস্তন আদালতে পরিবেশ আদালত গঠন না করে এটি যদি উচ্চ আদালতে স্থাপন করা হয়, তাহলে এটি ভারতের ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনাল বা কেনিয়ার পরিবেশ আদালতের মতো কার্যকর হতো। কারণ, বিদ্যমান ব্যবস্থায় কেউ যদি অধস্তন আদালতে কোনো মামলায় রায় পান, তাহলেও সেটি উচ্চ আদালতের নানা পর্যায়ে নিষ্পত্তির জন্য যাবে। সাধারণত পরিবেশদূষণকারীরা অনেক বেশি শক্তিশালী হয়। তাদের বিরুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের এত দীর্ঘ সময় মামলা পরিচালনা করা মুশকিল। এ ছাড়া আরেকটি বিষয় হলো– পরিবেশ আদালতের সংশ্লিষ্ট বিচারকদের পরিবেশ-সংক্রান্ত বিশেষায়িত জ্ঞান না থাকা। এ জন্য উচ্চ আদালতে বিচারপতির পাশাপাশি পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে যদি পরিবেশ-সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির পাশাপাশি যুগান্তকারী অনেক রায় পাওয়া যেত।’

ঢাকার পাশের তুরাগ নদের দখল ও দূষণ বন্ধে ২০১৯ সালের ৩০ জানুয়ারি রায় দেন হাইকোর্ট। রায়ে দেশের সব নদনদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করে তা রক্ষায় সরকারকে কয়েক দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়। পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের সভাপতি অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদের করা এক রিটে হাইকোর্ট এ রায় দেন। পরিবেশদূষণ রোধে করণীয় প্রসঙ্গে মনজিল মোরসেদ সমকালকে বলেন, ‘পর্যাপ্ত পরিবেশ আদালত না থাকায় দূষণ রোধে ভ্রাম্যমাণ আদালত অনেক ক্ষেত্রে ভরসা হিসেবে কাজ করেছে। তবে সেটিও পর্যাপ্ত নয়। কারণ, মাঝেমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হয়ে থাকে। এ জন্য পরিবেশ আদালত গঠনের পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম আরও জোরদার করা প্রয়োজন।’

পরিবেশ আদালতে মামলার স্বল্পতা থাকলেও পরিবেশ অধিদপ্তর নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালতে মামলা করে থাকে। যদিও পরিবেশ সুরক্ষায় তা যথেষ্ট নয়। ২০১০ সাল থেকে গত এপ্রিল পর্যন্ত পরিবেশ অধিদপ্তর ভ্রাম্যমাণ আদালতে ১২ হাজার ২৯৭টি মামলা করেছে। এর মধ্যে গত জুলাই থেকে এ বছরের এপ্রিল পর্যন্ত হয়েছে ২ হাজার ৪৩৮টি মামলা। মামলাগুলোর মধ্যে অধিকাংশই অবৈধ ইটভাটা, গাড়ির কালো ধোঁয়া, শব্দদূষণ, জলাশয় ভরাট, অবৈধ পলিথিন উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিপণন, পরিবেশ ছাড়পত্র না নিয়ে প্রতিষ্ঠানে কার্যক্রম পরিচালনা, শিল্পকারখানায় বর্জ্য শোধনাগার না থাকা এবং বর্জ্য, ডোবা ও নালায় নির্গমন করাসহ পরিবেশদূষণ সংক্রান্ত বিভিন্ন অপরাধ। এসব মামলায় গত ১৪ বছরে আসামিদের বিভিন্ন অঙ্কের আর্থিক জরিমানা করা হয়েছে, যা প্রায় ৪৯০ কোটি টাকা। তবে এর মধ্যে আদায় হয়েছে ২৩৯ কোটি ৯৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা।

পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়কমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন সমকালকে বলেন, পরিবেশদূষণের বহুমাত্রিক ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে– বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, নদীদূষণ, কালো ধোঁয়া, বিষাক্ত বর্জ্যসহ অনেক কিছু। আমরা চেষ্টা করছি। ২০২৬ সালের মধ্যে প্লাস্টিকের যথেচ্ছ ব্যবহার এবং এ-সংক্রান্ত দূষণ রয়েছে, তা কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ শুরু করেছি। আর বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ রোধসহ নানা বিষয়ে আমাদের প্রকল্প চলমান। আশা করছি, পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টি আরও গতিশীল হবে।

পরিবেশ-সংক্রান্ত মামলার ক্ষেত্রে নাগরিকের এখতিয়ার না থাকা প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, পরিবেশ আইনকে আরও গতিশীল করতে সম্প্রতি বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। এটি নাগরিকের জন্য সহায়ক হবে।