রাজধানীর বায়তুল মোকাররমের উল্টো পাশটায় রেস্তোরাঁ ‘বার্ডস আই’। ২০২২ সালের ১৫ জানুয়ারি সেই রেস্তোরাঁর ছাদে বসে গোপন বৈঠক। ওই সময় পরিকল্পনাকারীদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত ছিলেন বিদেশে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান ও ফ্রিডম মানিক। সেখানেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত– মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপুকে আর বাঁচিয়ে রাখা যাবে না।

গেল বছর দেশজুড়ে বেশ আলোড়ন তুলেছিল টিপু হত্যাকাণ্ড। এ মামলার তদন্ত পুরোপুরি গুছিয়ে নিয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। আজ-কালের মধ্যে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) আদালতে জমা দেওয়ার কথা রয়েছে।

অভিযোগপত্রে আসামি করা হচ্ছে ৩৪ জনকে। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও জাতীয় পার্টির একাধিক পদধারী নেতা আসামির তালিকায় থাকছেন। আছেন সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলরও। হত্যাকাণ্ডে কার কী ভূমিকা ছিল, তা তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। তদন্ত-সংশ্লিষ্ট একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র থেকে গতকাল রোববার এসব তথ্য মিলেছে।

তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মতিঝিল-ফকিরাপুল এলাকার চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভর্তি বাণিজ্য, বাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে রেষারেষি থেকেই টিপুকে হত্যা করা হয়েছে। ওই এলাকায় টিপুর আধিপত্য মানতে পারছিলেন না অনেকে। এ ছাড়া বিদেশে পলাতক সন্ত্রাসীদের সঙ্গেও এলাকার আধিপত্য ও ভাগবাটোয়ারা নিয়ে টিপুর দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছিল।

আসামির তালিকায় যাঁরা

অভিযোগপত্রে যাঁদের নাম থাকছে, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন– ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আশরাফ তালুকদার, দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা মারুফ আহমেদ মনসুর, বিদেশে পলাতক আন্ডারওয়ার্ল্ডের দুই সন্ত্রাসী জিসান ও ফ্রিডম মানিক, মতিঝিল থানা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক খায়রুল ইসলাম, মতিঝিল থানা জাতীয় পার্টির নেতা জুবের আলম খান রবিন, হাবীবুল্লাহ বাহার কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক সোহেল শাহরিয়ার, ১০ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি মারুফ রেজা সাগর, ১১ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সভাপতি কামরুজ্জামান বাবুল, ১০ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সাবেক সদস্য কাইল্যা পলাশ, একই ওয়ার্ড যুবলীগের সাবেক নেতা আমিনুল, ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক ‘ঘাতক’ সোহেল, সুমন শিকদার মুসা, মুসার ভাগনে সৈকত, মুসার ভাতিজা শিকদার আকাশ, ইমরান হোসেন জিতু, মোল্লা শামীম, রাকিব, বিডি বাবু, ওমর ফারুক, ‘কিলার’ নাসির, রিফাত, ইশতিয়াক হোসেন জিতু, মাহবুবুর রহমান টিটু, হাফিজ, মাসুম ও রানা মোল্লা। এঁদের মধ্যে ২৪ জনই গ্রেপ্তার হয়েছেন।

টিপু হত্যা মামলায় তিন আসামি আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। তাঁরা হলেন– মুসা, শুটার আকাশ ও নাসির উদ্দিন মানিক। এ ছাড়া সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দিয়েছেন একজন। তদন্তে উঠে এসেছে এই হত্যাকাণ্ডে দুটি অস্ত্র ব্যবহার হয়। এর একটি ছিল ইশতিয়াকের, আরেকটি সৈকতের কাছ থেকে নিয়ে শামীমকে দেওয়া হয়। ইশতিয়াকের পল্টনে অস্ত্র-গুলির দোকান রয়েছে। হত্যাকারীরা তাঁর দোকান থেকেই গুলি সংগ্রহ করেছিল।

এদিকে হাবীবুল্লাহ বাহার কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক সোহেল শাহরিয়ার কাওসার হত্যা মামলার আসামি হয়ে প্রায় ৯ বছর কানাডায় ছিলেন। গত বছর তিনি দেশে ফিরে যুবলীগের পদ বাগানোর চেষ্টা করেছিলেন।

কেন হত্যাকাণ্ড

একসময় রাজধানীর মতিঝিল, কমলাপুর, শাহজাহানপুরসহ আশপাশ এলাকা সন্ত্রাসী ফ্রিডম মানিক ও জিসানের কবজায় ছিল। ঠিকাদারি কাজের পাশাপাশি সরকারি জায়গা নিয়ন্ত্রণ, এজিবি কলোনিতে আধিপত্য নিয়ে টিপুর সঙ্গে তাঁদের বিরোধ বাড়তে থাকে। টিপু বলয়ের বাইরে থাকা নেতাকর্মী মনে করত, তাঁকে সরানো না গেলে তারা লাভবান হতে পারছে না। এমনকি মতিঝিলের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য অন্যরা টিপুর কাছে কোটা দাবি করে। একাধিকবার মতিঝিলকেন্দ্রিক বাণিজ্যের ভাগ অন্যদের দেওয়ার জন্য টিপুকে প্রস্তাব দেওয়া হয়। এতে রাজি না হওয়ায় সুবিধাপ্রত্যাশী চক্রটি টিপুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। টিপুকে হত্যা করতে কয়েক দফায় বিভিন্ন জায়গায় তারা বৈঠকও করে। বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ওই এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিতে তারা ছিল মরিয়া। এ কারণে অপরাধজগতের ডনদের নিয়ে টিপুকে সরিয়ে দেওয়ার ছক কষে তারা।

তদন্তে উঠে এসেছে, পরিকল্পনা অনুযায়ী টিপুকে গুলি করেন শুটার মাসুম। বন্ধু শামীমের মোটরসাইকেলে ঘটনাস্থলে যান তিনি। টিপুকে গুলি করে শামীমের মোটরসাইকেলে এলাকা ছাড়েন মাসুম।

কে এই জিসান ও মুসা

আলোচিত এই মামলার অভিযোগপত্রে এক নম্বর আসামি হচ্ছেন পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান আহমেদ মন্টি। টিপু হত্যার ভেতর দিয়ে আবার আলোচনায় আসেন জিসান। রাজধানীর গুলশান, বনানী, পল্টন, মগবাজার, মালিবাগ, ফকিরাপুল, মতিঝিল এলাকায় একসময় দাপিয়ে বেড়াতেন তিনি। অভিজাত এসব এলাকার ব্যবসা ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়মিত চাঁদা তুলতেন। তালিকাভুক্ত ২৩ সন্ত্রাসীর একজন তিনি।  ইন্টারপোল তাঁর নামে রেড অ্যালার্ট জারি করে রেখেছে।
সংস্থাটির ওয়েবসাইটে তাঁর বিষয়ে বলা আছে, হত্যাকাণ্ড ঘটানো এবং বিস্ফোরক বহনের অভিযোগ আছে। ২০০৩ সালে মালিবাগের একটি হোটেলে দুই ডিবি পুলিশকে হত্যার পর আলোচনায় আসেন জিসান। ২০০৫ সালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের মুখে তিনি দেশ ছাড়েন। জিসান ও আরেক সন্ত্রাসী ফ্রিডম মানিকের ‘ছায়া’ পেয়েই টিপু হত্যাকাণ্ডে সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেন সুমন শিকদার মুসা। তিনি ঢাকার অপরাধজগতের আরেক নিয়ন্ত্রক। টিপু হত্যার সমন্বয়কারী হিসেবে আবার তাঁর নাম সামনে এলো। এর আগে ২০১৬ সালে মতিঝিলে যুবলীগ কর্মী রিজভী হাসান ওরফে ‘বোঁচা বাবু’ হত্যার সময়ও শুটারকে ভাড়ার দায়িত্ব ছিল তাঁর। বাবু হত্যা মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি তিনি। বিচার চলাকালে আদালতে আইনজীবীর মাধ্যমে করোনার সনদ দাখিল করে ১২ মার্চ শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হয়ে দুবাই পালিয়েছেন মুসা। পালানোর আগে ১০ বছর মেয়াদি নতুন পাসপোর্টও করেন। এর আগে টিপু হত্যার সব ছক চূড়ান্ত করেন।

কারা কী বলছেন

মামলার বাদী টিপুর স্ত্রী ফারজানা ডলি ইসলাম সমকালকে বলেন, ‘মন ভালো নেই। এখনও চার্জশিট দিচ্ছে না। তদন্ত ও জবানবন্দিতে যাদের নাম এসেছে, তাদের কেউ যেন চার্জশিট থেকে বাদ না যায়। ৬-৭ বার আমাকে হুমকি দেওয়া হয়েছে। ছয়টি জিডি করেছি।  ন্যায়বিচার যাতে পাই– এই নিশ্চয়তা চাই।’

ফারজানা আরও বলেন, ‘আমার স্বামী যদি এত বড় অপরাধী হতো তাহলে কেন লোক নিয়ে খুন করা লাগল। এলাকার নিয়ন্ত্রণ দুর্বৃত্তরা নেওয়ার জন্য তাকে পরিকল্পিতভাবে মারা হয়েছে। সে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল।’ 

ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) হারুন অর রশিদ বলেন, টিপু হত্যা মামলার তদন্ত শেষ। দু-এক দিনের মধ্যে অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।

মামলার তদারক কর্মকর্তা ডিবির মতিঝিল বিভাগের ডিসি রাজীব আল মাসুদ সমকালকে বলেন, শুরু থেকে গুরুত্ব দিয়ে মামলাটির তদন্ত করা হয়েছে। খুঁটিনাটি তথ্য নিখুঁতভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।