গলায় ফাঁস দেওয়া অবস্থায় ঝুলছে ১০ বছরের শিশু জনির নিথর দেহ– এমন ভিডিও পাঠানো হয় মধ্যপ্রাচ্যে তার মায়ের কাছে। সেটি দেখে আঁতকে ওঠেন ওই প্রবাসী নারী। একটু পর দেশ থেকে তাঁর স্বামী ফোন করে তাঁকে জানান, বালিশ চাপা দিয়ে শ্বাসরোধে হত্যার পর সন্তানকে গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলিয়ে দিয়েছেন। স্ত্রীর ওপর ক্ষোভ থেকে এমনটা করেছেন বলে জানান তিনি। শিশুটির পাগলপ্রায় মা এরপর বারবার চেষ্টা করেও স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি। দেশে থাকা স্বজনরাও তাঁর সন্ধান পাননি।

এ ঘটনায় শিশু হত্যার অভিযোগে একটি মামলা হয়। সেই মামলার তদন্তে নেমে কথিত হত্যাকাণ্ডের ১০ মাস পর শিশুটিকে জীবিত উদ্ধার করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। সেই সঙ্গে হত্যার নাটক সাজিয়ে আত্মগোপনে থাকা আবদুল জলিলকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সোমবার শিশুটি আদালতে ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতে ওই ঘটনা বর্ণনা করেছে।

পিবিআইর জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার সাগর সরকার বলেন, শিশুটির নানী বকুল আক্তার বাদী হয়ে আদালতে মামলা করেন। সেটির তদন্ত করে পিবিআই। বাদীর বর্ণনা অনুযায়ী, ঢাকার ডেমরার সারুলিয়ার নিরো হাসপাতালের পশ্চিম পাশে হাজীনগর স্টাফ কোয়ার্টারের বাসায় গত বছরের ৯ আগস্ট কথিত হত্যাকাণ্ড ঘটে। তদন্তে নেমে রোববার রাতে উত্তর যাত্রাবাড়ীর বিবির বাগিচা এলাকার বাসায় অভিযান চালিয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়। সেখানেই শিশুটিকে জীবিত অবস্থায় পাওয়া যায়।  

তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানান, শারমীন ২০১৫ সাল থেকে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে আসছেন। তাঁর চার সন্তানের মধ্যে বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে। মেজ মেয়ে তাঁর চাচার কাছে এবং ছোট মেয়ে নানীর কাছে থাকে। আর ছোট ছেলে জনি থাকত বাবার সঙ্গে। ছেলের জন্য নিয়মিত বিদেশ থেকে স্বামীর কাছে টাকা পাঠাতেন শারমীন। জলিল সেই টাকা মদ-গাঁজা খেয়ে ও জুয়া খেলে উড়িয়ে দিতেন। এরপর তিনি আবারও স্ত্রীকে টাকা পাঠানোর জন্য চাপ দিতেন। চাহিদা অনুযায়ী টাকা না পেলে তিনি মেয়েদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও জনিকে মারধর করতেন। এসব কারণে পরে মেয়েরা বাবার থেকে আলাদা হয়ে যায়। তখন টাকার দরকার হলেই জনিকে মারধর করে সেই ভিডিও-ছবি স্ত্রীর কাছে পাঠান। এরই ধারাবাহিকতায় ঘটনার রাতে তিনি জনিকে বেধড়ক পেটান। পরে তার গলায় গামছা পেঁচিয়ে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে দিয়ে ভিডিও করেন। মারধরের কারণে তখন জনি নিস্তেজ ছিল, সেই সঙ্গে বাবার হুমকি-ধমকিতে সে ফাঁস দেওয়া অবস্থায় মৃতের মতো ঝুলছিল। ওই ভিডিও দেখে তার মায়ের মনে হয়, সত্যিই সন্তানকে হত্যা করেছে তাঁর স্বামী। পরে দ্রুত ছেলেকে ফাঁস থেকে নামিয়ে আনেন জলিল। এতে প্রাণে বেঁচে যায় জনি।

মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইর পরিদর্শক রওশন আলী জানান, তদন্তে নেমে প্রথমে জলিলের একটি মোবাইল ফোন নম্বর সংগ্রহ করা হয়। সেটিতে কল করে তাঁকে পিবিআই কার্যালয়ে আসতে বলা হয়। কিন্তু তিনি না আসায় আবারও ফোন করে দেখা যায়, নম্বর বন্ধ। তখন তাঁর জাতীয় পরিচয়পত্রের সূত্র ধরে একাধিক মোবাইল ফোন নম্বরের নিবন্ধন পাওয়া যায়। তবে সেগুলোও ছিল বন্ধ। শেষে বিভিন্ন সোর্সের সহায়তায় তাঁর বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে জানা যায়।

এদিকে বাবার নির্যাতনে অতিষ্ঠ শিশুটি এখন মা বা অন্য কোনো আত্মীয়ের কাছে থাকতে চায়। মারধর ছাড়াও তার ওপর নানাভাবে মানসিক অত্যাচার চালাতেন জলিল। ১০ বছর বয়স হলেও সন্তানকে স্কুলে ভর্তি বা পড়ালেখার কোনো ব্যবস্থা করেননি তিনি।