- বাংলাদেশ
- ভোটের নগরে বিদ্যুৎ যায় না
ভোটের নগরে বিদ্যুৎ যায় না

প্রচণ্ড গরমে ত্রাহি অবস্থা সারাদেশে। লোডশেডিংয়ে জীবন জেরবার। কিন্তু তুলনামূলক ভালো আছে ভোটের চার শহর বরিশাল, খুলনা, সিলেট ও রাজশাহী। ভোটারদের তুষ্ট রাখতে ‘ওপরের নির্দেশে’ এসব শহরে লোডশেডিং তেমন দেওয়া হচ্ছে না। সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগেভাগে এ চার নগরীতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে সিটির বাইরে বিদ্যুতের দুর্ভোগ অসহনীয়। বরিশাল ও খুলনায় ১২ জুন এবং সিলেট ও রাজশাহীতে ২১ জুন ভোটের তারিখ নির্ধারিত আছে।
বিতরণ কোম্পানির কর্মকর্তারা বলছেন, ‘ওপরের নির্দেশনায় সিটি নির্বাচন এলাকায় লোডশেডিং কমিয়ে আনা হয়েছে। কোথাও কোথাও নিরবচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে।’
যদিও বিষয়টির সমালোচনা করেছেন খাত-সংশ্লিষ্টরা। সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার সমকালকে বলেন, এটি অনৈতিক। অন্যায়ভাবে ভোটারদের প্রভাবিত করার প্রচেষ্টা হচ্ছে। শুধু ভোটের জন্য নির্দিষ্ট এলাকায় সরকারিভাবে বিশেষ সুবিধা প্রদানের সমালোচনা করে তিনি আরও বলেন, এটা অন্য প্রার্থীদের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নষ্ট করবে। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) উচিত বিষয়টি খতিয়ে দেখা। যোগাযোগ করা হলেও নির্বাচন কমিশনের কারও বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে কথা বলতে বিদেশ সফররত বিদ্যুৎ সচিব হাবিবুর রহমানের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি দেশে ফিরে কথা বলবেন বলে জানান।
এদিকে, ঢাকার কিছু ভিআইপি এলাকাও লোডশেডিংয়ের চরম ভোগান্তি থেকে মুক্ত রয়েছে বলে জানা গেছে।
দেশজুড়ে চলছে তাপদাহ। এ সময়েই বেড়ে গেছে বিদ্যুতের ভোগান্তি। গত এক সপ্তাহ মাত্রাছাড়া লোডশেডিংয়ের কবলে দেশ। সরকারি তথ্যমতেই, লোডশেডিং হচ্ছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াট। বেসরকারি হিসাবে এর পরিমাণ প্রায় পাঁচ হাজার মেগাওয়াট। ডলার সংকটে জ্বালানি সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ায় চাহিদা অনুসারে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। এর মধ্যে সোমবার দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র পায়রা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে লোডশেডিং আরও বেড়েছে। এলাকাভেদে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। যদিও বরিশাল ও খুলনা নগরীতে গত শনিবার থেকে বিদ্যুতের ভোগান্তি নেই বললেই চলে। সিলেট ও রাজশাহী নগরে লোডশেডিং অনেকটা কমে গেছে।
লোডশেডিংমুক্ত বরিশাল
গত শুক্রবার পর্যন্ত বিদ্যুতের আসা-যাওয়ায় অতিষ্ঠ ছিলেন নগরবাসী। কিন্তু শনিবার থেকে আকস্মিকভাবে বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটে। জানা গেছে, নির্বাচন উপলক্ষে নগরীতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো) সূত্রে জানা গেছে, বরিশাল নগরীর চাহিদা হচ্ছে ৭১ মেগাওয়াট। নগরীর রূপাতলী গ্রিড সাবস্টেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আখতারুজ্জামান জানান, সিটি করপোরেশন নির্বাচনের জন্য ‘ঊর্ধ্বতন মহলের সিদ্ধান্তে’ নগরে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। তাই গত শনিবার থেকে বরিশাল নগরে লোডশেডিং করা হচ্ছে না। কারিগরি ত্রুটির কারণে কোথাও বিদ্যুৎ গেলেও দ্রুত সরবরাহ করা হয়। বরিশালের বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগ-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ফারুক হোসেন বলেন, গত কয়েক দিন যাবৎ তাঁরা চাহিদার সবটুকু বিদ্যুৎ পাচ্ছেন। যে কারণে লোডশেডিং করতে হচ্ছে না। বরিশাল পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ এর মহাব্যবস্থাপক সাদেকুর রহমান জানান, পিক আওয়ারে ৬০ মেগাওয়াট চাহিদা রয়েছে। ৫০ মেগাওয়াটের বেশি সরবরাহ পাচ্ছেন। এতে তেমন সমস্যা হচ্ছে না।
তবে নগরীর আশপাশের এলাকায় লোডশেডিং ভয়াবহ। নগরীঘেঁষা কীর্তনখোলা নদীর পূর্ব তীরে চরকাউয়া ইউনিয়নের নয়ানী গ্রাম থেকে বরিশাল নগরী দেখা যায়। এই গ্রামের রূহুল আমিন রেমন শরীফ জানান, সোমবার রাত ১টা থেকে এক ঘণ্টা বিদ্যুৎ ছিল না। ২টায় বিদ্যুৎ আসার পর ঘুমিয়েছেন। এর পরে শেষরাতে আরও দু’বার বিদ্যুৎ গিয়েছিল। লোডশেডিংয়ে জীবন অতিষ্ঠ।
লোডশেডিংমুক্ত খুলনার পেছনে আওয়ামী প্রার্থী!
গত চার দিন ধরে খুলনায় কোনো লোডশেডিং নেই বললেই চলে। এর আগে প্রতিদিন ৪-৫ ঘণ্টা লোডশেডিং হতো। ওজোপাডিকো সূত্রে জানা গেছে, খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় ৬ জুন বিকেল ৩টায় বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ৫৬৯ মেগাওয়াট ও সরবরাহ ছিল ৪৬৪ মেগাওয়াট। লোডশেডিং ছিল ১০৫ মেগাওয়াট। তবে খুলনা নগরীতে কোনো লোডশেডিং ছিল না। পাশের জেলা যশোরে এ সময় ২০, সাতক্ষীরায় ৭, মাগুরায় ৪, নড়াইলে ৪, কুষ্টিয়ায় ১৩, ঝিনাইদহে ১১ ও চুয়াডাঙ্গায় ৮ মেগাওয়াট লোডশেডিং ছিল। খুলনা বিভাগে ৫ জুন ১১২ মেগাওয়াট, ৪ জুন ৯৩ মেগাওয়াট লোডশেডিং ছিল। বিপরীতে ৫ জুন নগরীতে লোডশেডিং ছিল না। ৪ জুন ঘাটতি ছিল মাত্র ২ মেগাওয়াট। ৩ জুনও খুলনা নগরীতে লোডশেডিং হয়নি।
আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী তালুকদার আব্দুল খালেক সোমবার সকালে নগরীর কাশেমনগর এলাকায় গণসংযোগকালে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘খুলনায় কয়েক দিন আগে বেশি পরিমাণে লোডশেডিং হচ্ছিল। তখন আমি বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীকে ফোন করে পাইনি। তার পর আমার স্ত্রী পরিবেশ ও বন উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহারকে বলি সংসদে গিয়ে তাঁর সঙ্গে আলাপ করো। আমাদের এইখানে এভাবে বিদ্যুৎ গেলে মানুষের প্রতিক্রিয়া খারাপের দিকে যাবে। তার পর থেকে তো বিদ্যুৎ আর তেমন যাচ্ছে না।’ এ বিষয়ে মঙ্গলবার দুপুরে তালুকদার খালেক সমকালকে বলেন, ‘এখন তো লোডশেডিং নেই। গরমে মানুষের সেই দুর্ভোগ হচ্ছে না।’
ওজোপাডিকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেখ আকতার হোসেন বলেন, সাধারণত গ্রামের তুলনায় শহরে লোডশেডিং কম রাখা হয়। আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীর উদ্যোগের ব্যাপারে তিনি বলেন, এ সম্পর্কে আমার ধারণা নেই।
নগরের বাইরে পাইকগাছা, কয়রা, রূপসাসহ বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহকারী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজার মো. জিল্লুর রহমান জানান, মঙ্গলবার দুপুরে তাঁদের এলাকায় ২০ মেগাওয়াট লোডশেডিং ছিল, যা চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ। সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) খুলনার সভাপতি অ্যাডভোকেট কুদরত ই খুদা বলেন, ‘এটা আওয়ামী লীগের প্রার্থীর ভোটে জেতার একটা কৌশল, যাতে গরমে লোডশেডিংয়ে মানুষ অতিষ্ঠ না হয়।’
ভোগান্তি কমেছে সিলেট ও রাজশাহীতে
সিটি করপোরেশন (সিসিক) নির্বাচন উপলক্ষে সিলেট ও রাজশাহী নগরীতে লোডশেডিং কমে গেছে। আগে যেখানে ২৪ ঘণ্টায় ৫-৭ ঘণ্টা লোডশেডিং হতো, সেখানে গত কয়েক দিন থেকে আধা ঘণ্টা থেকে দুই ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। তবে উপজেলা পর্যায়ের গ্রাহকরা অধিকাংশ সময় থাকছেন বিদ্যুৎহীন।
সিলেট সদর উপজেলার কামালবাজারের নোমান আহমদ জানিয়েছেন, কিছু দিন আগে গড়ে ৬ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকত না। গত কয়েক দিন ধরে বেশি সময়ই বিদ্যুৎ পাচ্ছেন তারা। সিলেটের বিদ্যুৎ বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ আব্দুল কাদির সমকালকে জানিয়েছেন, ওপরের নির্দেশনায় যেসব এলাকায় সিটি নির্বাচন হচ্ছে– সেখানে লোডশেডিং কমিয়ে আনা হয়েছে। তিনি বলেন, সিলেট সিটি করপোরেশন এলাকায় ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদার বিপরীতে এখন ১৪০-৪৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাচ্ছি। তবে গ্রামে এখন প্রতিদিন ৩০-৪০ ভাগ সময় লোডশেডিং হচ্ছে। ২১ জুন নির্বাচনের পর সিটি ও গ্রামে সামঞ্জস্য আসবে। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি সিলেট-১-এর জেনারেল ম্যানেজার আক্তারুজ্জামান লস্কর জানিয়েছেন, তাঁর অধীন এলাকায় ৫-৬ ঘণ্টা লোডশেডিং হয়। রাজশাহীতে বিদ্যুৎ সরবরাহের দায়িত্বে থাকা নর্দান পাওয়ার ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানির (নেসকো) সূত্র জানিয়েছে, রাজশাহী নগরীতে এখন সর্বোচ্চ ২ ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে, যা আগে বেশি ছিল।
ঢাকার ভিআইপি এলাকায় লোডশেডিং নেই
সারাদেশের মতো ঢাকায়ও দিনে ৬-৭ ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। তবে ঢাকার কয়েকটি এলাকায় লোডশেডিং নেই। জানা গেছে, এসব এলাকায় ভিআইপি ব্যক্তিদের বসবাস হওয়ায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দেওয়া হয়। এর মধ্যে বনানী ও পরিবাগের একটি এলাকা রয়েছে।
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছে ব্যুরো অফিস]
মন্তব্য করুন