- বাংলাদেশ
- ‘ঘরপোড়া’ বিএনপির দাবি আদায় ফর্মুলা
সংলাপের ঢেউ, পাল্টা হাওয়া
‘ঘরপোড়া’ বিএনপির দাবি আদায় ফর্মুলা
২০১৪ ও ২০১৮ সালের সংলাপ মাথায় রেখেই ‘সতর্ক’ সংগঠনটি

আগামী নির্বাচন সামনে রেখে চলমান রাজনৈতিক সংকট সমাধানে এবার ‘সতর্ক’ পা রাখবে বিএনপি। সরকারের নানা কলাকৌশলের কোনো ‘সংলাপের টোপ’ গিলবে না দলটি। শান্তিপূর্ণ গণআন্দোলনের মাধ্যমে রাজপথেই নির্দলীয় সরকারের অধীনে আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের দাবি আদায়ে দৃঢ় আশা বিএনপির। অতীতের ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় এবং ২০১৮ সালের সরাসরি নিজেরা সংলাপে বসার অভিজ্ঞতা মাথায় রেখেই এ পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে দলটি। দলটির একাধিক নীতিনির্ধারক নেতা এ পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন।
দলটির নেতারা জানান, এবার আর কোনো ‘ফাঁদে’ পা দেবেন না তাঁরা। চলমান আন্দোলনকে পর্যায়ক্রমে তুঙ্গে তুলে এক দফায় রূপান্তর করে রাজপথ দখলের মাধ্যমেই সরকারকে দাবি আদায়ে বাধ্য করতে চায় বিএনপি। সংলাপের মাধ্যমে সরকার মন্ত্রিসভা বা অন্যান্য ব্যাপারে ছাড় দেওয়ার যে কোনো ফর্মুলায় তাদের অধীনেই নির্বাচন করতে চাইবে। বিএনপির নীতিনির্ধারকদের কাছে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাওয়ায় এখন সংলাপের চেয়ে রাজপথেই শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলতেই বেশি জোর দিচ্ছেন তাঁরা।
অবশ্য রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, যতক্ষণ সরকার আনুষ্ঠানিক উদ্যোগ না নেবে ততক্ষণ পর্যন্ত দলীয় নেতাদের সংলাপ নিয়ে দেওয়া বক্তব্যের কোনো গুরুত্ব নেই। তবে রাজনীতিবিদদের জন্য আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমুর বক্তব্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিবদমান দুটি পক্ষের মধ্যে সমঝোতার জন্যই মধ্যস্থতাকারীর প্রয়োজন আছে। আর সে জন্য তাঁর মতো একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ বিশ্বের অভিভাবক হিসেবে নিরপেক্ষ সংস্থা জাতিসংঘের কথা বলেছেন। অতীতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জাতিসংঘই মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করেছে।
সংঘাত ও সহিংসতার পথ থেকে দেশ ও জনগণকে রক্ষা করেছে। সংকট নিরসনে এবারও আমুর বক্তব্যকে সরকারি দল গুরুত্ব না দিলে রাজনীতিবিদদেরই মাশুল দিতে হতে পারে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সমকালকে জানান, সংলাপের মাধ্যমে সরকার জনগণকে বিভ্রান্ত করতে চায়। জনরোষ থেকে বাঁচতে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে নিয়ে যেতে চায়। লাভ হবে না। জনগণ ধোঁকা খেতে খেতে এখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। বিএনপিও এসব সংলাপের কলাকৌশল বুঝে গেছে। নির্দলীয় সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচনের দাবি মেনে সবার আগে পদত্যাগের ঘোষণা দিতে হবে। তারপর শুধু নির্দলীয় সরকারের কাঠামো নিয়ে আলোচনা হতে পারে। এর আগে অন্য কিছু নিয়ে কোনো সংলাপ নয়। দাবি আদায়ে তাঁরা রাজপথেই সরকারকে বাধ্য করবেন। সারাদেশের মানুষ জেগে উঠেছে।
একই সঙ্গে মির্জা ফখরুল আরও বলেন, দেশি-বিদেশি সবাই আওয়ামী লীগের চরিত্র বুঝে গেছে। মুখে সুষ্ঠু নির্বাচনের যত কথাই বলুক, সরকারে থেকে তাদের অধীনে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। ইতোমধ্যে বিগত দুটি জাতীয় এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতেই তা প্রমাণিত হয়েছে। আর সে জন্যই দুর্ভাগ্যজনকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের মতো বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ সুষ্ঠু ভোটে বাধা দিলে ভিসা পাবে না বলেও ঘোষণা দিয়েছে।
কূটকৌশল মোকাবিলায় কূটকৌশল
বিএনপি সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের কাছ থেকে দাবি আদায় এতটা সহজ নয় বলে মনে করেন দলটির নেতারা। বিগত প্রায় ১৫ বছর টানা ক্ষমতায় থেকে বিরোধী দলকে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যাপক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে দলটি। বিরোধী দলকে মোকাবিলার নানা ধরনের কূটকৌশলের পাল্টা কূটকৌশল গ্রহণের পরিকল্পনা নিয়েছেন তাঁরাও। পরিস্থিতি ও সময় অনুযায়ী ওইসব কৌশল ব্যবহার করবে দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি। এখনই দলের সব নেতাকর্মী ও সমমনা জোটের সঙ্গেও সব কৌশল নিয়ে মতবিনিময় করছে না দলটির হাইকমান্ড।
অবশ্য এরই মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বের প্রভাবশালী দেশ ও সংস্থাকে নিজেদের দাবির স্বপক্ষে আনার জোর তৎপরতা চালিয়ে কিছুটা সফল হয়েছে বলে মনে করেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। বিশেষ করে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনে বাধা দেওয়া ব্যক্তি ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের ভিসা না দেওয়ার যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তটি বিএনপির অনুকূলেই এসেছে এবং তাদের আন্দোলনের ‘ফসল’ বলে মনে করেন। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি ঘোষণায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বেশ চাপে পড়েছে বলে তাদের বিশ্বাস। একই সঙ্গে অন্যান্য প্রভাবশালী দেশ ও সংস্থাগুলোও অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য চাপ তৈরি করছে বলে জানান বিএনপি নেতারা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী গতকাল সমকালকে বলেন, জনগণের সঙ্গে অনেক ধোঁকাবাজি করেছে আওয়ামী লীগ। ভোটের অধিকার হারা মানুষ আর ছাড় দেবে না তাদের। যতই চালাকি বা কূটকৌশল করুক না কেন, এবার জনগণ তাদের টেনেহিঁচড়ে ক্ষমতা থেকে টেনে নামাবে। বিএনপি আন্দোলনে আছে, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবে। অধিকারহারা মানুষের জনরোষের মাধ্যমে সরকারকে নির্দলীয় সরকারের দাবি মানতে বাধ্য করবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্দলীয় সরকারের অধীনে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের দাবি মেনে নেওয়ার পরই কেবল সংলাপ হতে পারে। এর আগে তাদের অধীনে নির্বাচনের জন্য কোনো সংলাপে যাবে না বিএনপি।
বিএনপির কয়েকজন নেতা জানান, আগামী দুই মাসের মধ্যে রাজপথের আন্দোলনের পাশাপাশি আরও নানা ধরনের চাপ আওয়ামী লীগকে মোকাবিলা করতে হবে। গণতন্ত্রমনা দেশ ও সংস্থাগুলোর মাধ্যমেও এ চাপ আসতে পারে। সরকার যতই মাথানত না করার কথা বলুক না কেন, ভেতরে ভিন্ন চিত্র। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে বাংলাদেশের সেনা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের না নেওয়ার ব্যাপারে মার্কিন ছয় সিনেটরের চিঠির বিষয়টি বিএনপির অনুকূলে এসেছে বলে মনে করেন দলটি নেতারা। এতে আগামী দিনের আন্দোলন-সংগ্রামে রাজপথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিছুটা হলেও নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাববে বলে জানান তাঁরা।
বিএনপির নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, শুধু বাইরের চাপের ওপর তাঁরা নির্ভর করছেন না। নিজেরাও রাজপথ দখলের জন্য জোর সাংগঠনিক তৎপরতা শুরু করেছেন। এতদিন দলের নিখোঁজ নেতা ও গায়েবি মামলার সংখ্যা ও নেতাকর্মীর তথ্যউপাত্ত সংগ্রহ করলেও এখন সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ জেলা ও মহানগরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের তথ্য সংগ্রহ করছেন তাঁরা। পাশাপাশি রাজপথের আন্দোলনে তরুণ সমাজকে সম্পৃক্ত করতে আগামী ১৪ জুন থেকে ছয়টি বিভাগীয় শহরে তারুণ্য সমাবেশের কর্মসূচি গ্রহণ করেছে দলটি। যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের উদ্যোগে এ সমাবেশগুলো হবে। আজ শ্রমিক দলের উদ্যোগে নয়াপল্টনে শ্রমিক সমাবেশ করবে তারা। নারীদের সম্পৃক্ত করতে নারী সমাবেশও করবে দলটি।
দলীয় সূত্র জানায়, সমমনা জোটের সঙ্গে টানাপোড়েন নিরসন করে অভিন্ন রূপরেখা খসড়া চূড়ান্ত করেছে বিএনপি। শিগগির চূড়ান্ত করে এক মঞ্চ থেকে এ রূপরেখা ঘোষণা করবে। তার পর এক দফা আন্দোলনে যাবে তারা। জনসম্পৃক্ত ইস্যুতে কর্মসূচিও দেবে। গতকাল বিদ্যুৎ সংকট মোকাবিলার দাবিতে সারাদেশের জেলা শহরে বিদ্যুৎ অফিসের সামনে অবস্থান ও স্মারকলিপি প্রদান করেছে তারা।
সূত্র আরও জানায়, দেশি-বিদেশির চাপেরমুখে একসময়ের ২০ দলীয় জোটের শরিক জামায়াতে ইসলামীকে দূরে সরিয়ে রাখলেও এখন আবার কৌশলে কাছে টানার উদ্যোগ নিয়েছে বিএনপি। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত সপ্তাহে জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহেরকে টেলিফোন করেছেন। জামায়াত নেতা টেলিফোনের বিষয়ে গণমাধ্যমের কাছে স্বীকারও করেছেন।
বিএনপির নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, বর্তমান সরকারের সময়ে নানাভাবে নির্যাতিত জামায়াতে ইসলামীর সাংগঠনিক শক্তিকে আন্দোলনের মাঠে কাজে লাগানোর লক্ষ্য থেকেই এ যোগাযোগ শুরু হয়েছে। তাদের সঙ্গে সরাসরি জোট বা সমমমনা দলের মধ্যে না রেখে দূর থেকেই সম্পর্ক বজায় রাখার কৌশল নিয়েছে বিএনপি। দাবি আদায়ে আন্দোলন জোরদার ও দেশি-বিদেশিদের মাধ্যমে সরকারের ওপর চাপ তৈরি করতে আগামী দিনগুলোতে আরও অনেক নতুন নতুন কৌশল গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি।
আরও পড়ুন
মন্তব্য করুন