- বাংলাদেশ
- নারকেল ছোবড়ার ইউরোপযাত্রা
নারকেল ছোবড়ার ইউরোপযাত্রা

দুই দশক আগের কথা। নারকেল তেলের ব্যবসা তখনও রমরমা। বাগেরহাট থেকে তখন সারাদেশে যেত নারকেল তেল। এইচএসসি পাস করে এক দশকের বেশি সময় ধরে এই ব্যবসায় যুক্ত মোস্তাফিজ আহমেদ তখন ভাবছিলেন নতুন এক ভাবনা। তেল উৎপাদনে জড়িত থাকায় তিনি দেখেন নারকেলের ছোবড়া পড়ে থাকে যত্রতত্র, আসে না কোনো কাজে। তিনি ভাবছিলেন, কীভাবে কাজে লাগানো যায় এই ছোবড়া। ফেলনা ছোবড়া দিয়ে নতুন পণ্য তৈরির ভাবনা ছিল তাঁর। সেই ভাবনা থেকে ২০০২ সালে শুরু হয় তাঁর নতুন উদ্যোগ ‘ন্যাচারাল ফাইবার’। তাঁর কারখানায় ছোবড়ার আঁশ দিয়ে কয়ার ফেল্ট (ম্যাট্রেস তৈরির কাঁচামাল) তৈরি শুরু হয়। ম্যাট্রেস ছাড়াও কয়ার ফেল্ট ব্যবহার হয় ইন্ডাস্ট্রিয়াল এয়ার ফিল্টার ও ইনসুলেশনের কাজে। ২০০৫ সালে উৎপাদনে যায় বাগেরহাটের ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশন (বিসিক) শিল্পনগরীতে তাঁর কারখানা। প্রথমবারের মতো দেশে উৎপাদন শুরু হয় নতুন ধরনের এই পণ্য।
ছোবড়া থেকে তৈরি পণ্যের তালিকায় ধীরে ধীরে যুক্ত হয় কোক পিট, ডিসপোজেবল স্লিপারের মতো পরিবেশবান্ধব নতুন নতুন সব পণ্য। মোস্তাফিজ আহমেদের (৫৬) সঙ্গে ব্যবসার হাল ধরেন তাঁর ছোট ভাই মোজাহিদ আহমেদ (৫৩)। বাগেরহাটের বিসিক শিল্পনগরীতে দুই সহোদরের কারখানায় কর্মসংস্থান হয়েছে শতাধিক কর্মীর। তাঁদের উৎপাদিত পণ্যের বড় অংশই রপ্তানি হয় জার্মানি, ইংল্যান্ড, গ্রিসসহ বিভিন্ন দেশে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির হাত ধরে দেশের রপ্তানিপণ্য তালিকায় নতুন করে যুক্ত হচ্ছে বাচ্চাদের জন্য কাঠের তৈরি সাইকেল, পোষা প্রাণীর খেলনা, সফট টয়, পাখির বাসাসহ বেশ কয়েক ধরনের পণ্য।
সম্প্রতি কারখানায় বসে এ প্রতিবেদকের কথা হয় দুই সহোদরের সঙ্গে। তাঁরা তুলে ধরেন, হার না মানা জীবনের এক অসাধারণ গল্পগাথা। মোস্তাফিজ আহমেদ জানান, ছোবড়া দিয়ে কিছু করার চিন্তায় ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশ-বিদেশ। ভারতের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ছোবড়া দিয়ে কয়ার ফেল্ট তৈরির কৌশল দেখলেন। যন্ত্রপাতি কিনতে গিয়ে প্রথমেই হোঁচট খেলেন, দাম আকাশছোঁয়া। কিন্তু হাল ছাড়ার জন্য সেখানে যাননি মোস্তাফিজ। পশ্চিমবঙ্গের এক কারখানার সঙ্গে চুক্তি করে কয়ার ফেল্ট তৈরি করে নিয়ে আসতে থাকলেন। এতে লাভ না হওয়ায় স্থানীয় উপকরণ ও মিস্ত্রি দিয়ে কয়ার ফেল্টের যন্ত্রপাতি তৈরি করে ফেলেন তিনি। ততদিনে পার হয়ে গেছে তিনটি বছর। এর আগেই কয়েকটি ম্যাট্রেসের কারখানার কাজ পেয়ে যান তিনি। পরে নিয়মিতই কাজ পেতে থাকেন।
মোস্তাফিজ জানান, ছোবড়ার আঁশের সঙ্গে তরল রাবার মিশিয়ে প্রথমে পাতলা শিট তৈরি করা হয়। পরে ম্যাট্রেস কোম্পানির চাহিদা অনুযায়ী কয়েকটি শিটকে তাপ ও চাপ দিয়ে এক ইঞ্চি থেকে সাড়ে পাঁচ ইঞ্চি পুরুত্বের কয়ার ফেল্ট প্রস্তুত করা হয়। প্রথম পণ্য যায় জার্মানিতে। তবে উদ্যমী ভাইদের চিন্তা এখানে সীমাবদ্ধ থাকেনি। নতুন পরিকল্পনা আর আন্তর্জাতিক বাজারে বেশি করে অংশগ্রহণের উদ্যোগ নেন। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট মেলায় অংশ নেন মোস্তাফিজ। সেখানে তিনি গিয়েছিলেন মূলত কয়ার ফেল্টের ক্রেতা খুঁজতে। জানতে পারেন বিশ্ববাজারে কয়ার পিটের চাহিদার বিষয়ে। মুস্তাফিজ বলেন, ‘ছোবড়ার গুঁড়া দিয়ে আমরা কয়ার পিট ব্লক তৈরির চিন্তাভাবনা করলাম। কারণ, বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই কয়ার পিটের ব্যাপক চাহিদা। তখন ইউএসএআইডির সহযোগিতায় ভারত থেকে যন্ত্রপাতি আমদানি করে ২০১৮ সাল থেকে আমরা পিট ব্লক উৎপাদন এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় রপ্তানি শুরু করি। বাংলাদেশ থেকে আমরাই প্রথম এই পিট ব্লক রপ্তানি শুরু করি।’
পণ্যের চাহিদা বাড়তে থাকায় ২০১৭ সালে তাঁরা নিজেরাই বাগেরহাট সদর উপজেলার কররী গ্রামে ছোবড়া থেকে আঁশ তৈরির কারখানা স্থাপন করেন। তবে বছর দুয়েক পরই বিশ্বজুড়ে আঘাত হানে মহামারি করোনা। ২০২০ সালে করোনার ধাক্কায় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় তাদের কারখানা। ক্রেতারা ওয়ার্ক অর্ডার বাতিল করায় ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন তাঁরা। মোজাহিদ আহমেদ বলেন, ‘প্রায় দুই বছর ধরে আমাদের দুটি কারখানাই বন্ধ থাকে। আমরা চেষ্টা করতে থাকি কীভাবে নতুন পণ্য দিয়ে আবারও বাজারে আসা যায়। এ জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ওয়েবসাইটে আমরা আমাদের নানা পণ্যের বিজ্ঞাপন দিই। সেখান থেকে একদিন গ্রিসের এক ক্রেতা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। প্রতিষ্ঠানটি আমাদের কাছে নতুন ধরনের একটি পণ্য, ডিসপোজেবল হোটেল স্লিপারের চাহিদা দেয়। ডিজাইন স্পেসিফিকেশন দিলে আমরা সে অনুযায়ী তাদের পণ্যের স্যাম্পল তৈরি করে পাঠাই। তারা আমাদের তৈরি স্যাম্পল পছন্দ করে এবং প্রথম দফাতেই ওই প্রতিষ্ঠান ৯০ হাজার জোড়া ডিসপোজেবল হোটেল স্লিপারের অর্ডার দেয়।’
কারখানাটির এক পাশে কয়ার ফেল্ট তৈরির ইউনিটে চলে স্লিপার তৈরির প্রথম ধাপ। ছোবড়ার আঁশ দিয়ে সেখানে তৈরি শিট থেকে নির্দিষ্ট মাপের ডাইচের সাহায্যে প্রথমে জুতার নিচের অংশ কেটে নেওয়া হয়। এরপর তা নিয়ে আসা হয় কারখানার অন্য অংশে। সেখানে টেইলারিং মেশিনে নারী শ্রমিকদের হাতেই মূল ডিসপোজেবল স্লিপারটি তৈরি হয়। পণ্যগুলো তৈরির পর তার খুঁটিনাটি পরীক্ষা করে প্রতি জোড়া একসঙ্গে করে কাগজের কার্টনে রাখা হয় রপ্তানির জন্য।
মোস্তাফিজ আহমেদ বলেন, ‘পণ্য তৈরি হলে প্যাকিংয়ের আগে কথা ছিল গ্রিসের ওই প্রতিষ্ঠান কোক-মার্ট আমাদের কারখানা ভিজিট করবে। তারা এখানে এসে আমাদের উৎপাদিত পণ্য দেখে খুশি হয়েছে। কয়ার ইয়োগা ম্যাট, ম্যাট্রেসের জন্য কয়ার শিট, বাচ্চাদের ম্যাট্রেস, স্যান বেডের মতো ছোবড়ার তৈরি পণ্যের পাশাপাশি কাঠের তৈরি বাচ্চাদের ব্যালান্সড সাইকেল, পোষা প্রাণী যেমন কুকুর-বিড়ালের বিছানা, ব্রাশ, খেলনা, ছাতা, বোতলসহ ৫ কোটি টাকার পণ্যের অর্ডার করেছে কোক-মার্ট। এ ছাড়া তাদের চাহিদা অনুযায়ী আমরা একটি কাঠের সাইকেল তৈরি করি। পছন্দ হওয়ায় ২০ হাজার সাইকেল অর্ডার করেছে প্রতিষ্ঠানটি।কাঠের একটি থ্রি হুইলারেরও চাহিদা দিয়েছেন এক ব্যক্তি। থ্রি হুইলারটি বাইসাইকেলের মতো চলবে, আবার ব্যাটারিতেও চলবে। কভারটা হবে যুদ্ধবিমানের ককপিট শেডের মতো।’ ইউরোপসহ উন্নত বিশ্বে এ ধরনের পণ্যের ব্যাপক চাহিদা। এই পণ্যের বৈশ্বিক বাজার পুরোটা প্রায় চীনের দখলে। ৩ মার্চ ডিসপোজেবল স্লিপার রপ্তানির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রথমবার এ ধরনের পণ্যের রপ্তানি শুরু হলো। মোস্তাফিজ বলেন, ‘আমরা এই বাজারে ঢুকলাম এবং আশা করছি, আন্তর্জাতিক এই বাজারে আমরা একটা ভালো অবস্থানে যাব। পাশাপাশি বাংলাদেশে এমন কারখানা আরও তৈরি হলে আরও বিদেশি ক্রেতা আসবেন।’
মোজাহিদ আহমেদের স্ত্রী রোজি আহমেদ বলেন, ‘করোনার সময় যখন সবকিছু বন্ধ হয়ে যায়, তখন বাড়িতে থেকেই কিছু একটা করার সিদ্ধান্ত নিই। যেহেতু আমাদের ছোবড়া বা আঁশ ছিল, তাই এটি দিয়ে পাখির বাসা বানানো শুরু করি। পর্যায়ক্রমে এখন আমরা ১৫ ধরনের পাখির বাসা, মালচিং ম্যাট, কোকো পোল, বাসকেট, ল্যাম্প শেডসহ প্রায় ২০ ধরনের পণ্য উৎপাদন করে থাকি। করোনাকালের সেই উদ্যোগের ফলে স্থানীয় ৪০ জন নারীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে।’ এ ছাড়া মোস্তাফিজ আহমেদের ছেলে মারজান আহমেদ ও মেয়ে মুন্নুজান আহমেদ মুন্নিও এ ব্যবসায় যুক্ত হয়েছেন।
মন্তব্য করুন