- বাংলাদেশ
- আমলাতন্ত্র শক্তিশালী করতে প্রস্তাবিত ভূমি আইন
আমলাতন্ত্র শক্তিশালী করতে প্রস্তাবিত ভূমি আইন
গোলটেবিল আলোচনায় বিশেষজ্ঞদের মত

রাজধানীর তেজগাঁওয়ে সমকাল সভাকক্ষে বুধবার ‘ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন ২০২১’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অতিথিরা -সমকাল
আমলাতন্ত্রকে শক্তিশালী করতেই ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইনের খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে। প্রস্তাবিত আইনের অনেক ধারা ও শাস্তি দেশের প্রচলিত আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এ আইনের মাধ্যমে ভূমিদস্যুদের শাস্তি কমিয়ে তাদের আরও দখলে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে বলে মনে করেন আইন বিশেষজ্ঞরা। গতকাল বুধবার বিকেলে রাজধানীর তেজগাঁওয়ের সমকাল সভাকক্ষে ‘ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন ২০২১’ শীর্ষক আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে তাঁরা এসব কথা বলেন।
সমকাল, অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি) এবং বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) যৌথভাবে এ বৈঠকের আয়োজন করে। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সুলতানা কামালের সভাপতিত্বে এবং পরিচালনায় বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মিনহাজুল হক চৌধুরী। স্বাগত বক্তব্য দেন সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খান।
আলোচনায় বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, এই আইনটার উদ্দেশ্য কী? আদৌ কোনো ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে সরকার এই আইন করছে কিনা? সরকারকে যদি আমি ‘বেনিফিট অব ডাউট’ দিই, তাহলে আমার মনে হয়, এই আইনটা একটা ভালো উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। এই ধরনের একটা গুরুত্বপূর্ণ আইন সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে পরামর্শ না করে চূড়ান্ত করা ঠিক হবে না। ভূমি মানুষের সাংবিধানিক অধিকার। সেই অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব একজন ম্যাজিস্ট্রেটের নয়, বরং এটি হাইকোর্টের হাতে তুলে দিতে হবে।
আবু সাঈদ খান বলেন, ভূমি দখলের মতো ভয়ংকর থাবা কোনোভাবেই থামছে না। এই দখলবাজদের মধ্যে ভূমিখেকো আছে, স্বার্থান্বেষী মহল আছে। এমনকি এই দলে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও নাম লিখিয়েছে। এর উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে তেলেগু সুইপার কলোনির কথা। সেখানকার মানুষগুলোকে তাদের জায়গা থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। তবে এর কোনো প্রতিকার হয়নি। আমার মনে হয়, তেলেগু সম্প্রদায় এবং সমতল ও পাহাড়ের আদিবাসীদের সম্পত্তি দখল করাটা খুব সহজ। আরেকটা সহজ কাজ হলো, সরকারি সম্পত্তি দখল করা। কোনো বাঙালি মুসলমানের সম্পত্তি দখল হলে, তখন মুসলিম সম্প্রদায় থেকে প্রতিবাদ হয়। যখন হিন্দুর সম্পত্তি দখল হয়, তখন বাঙালিদের মধ্য থেকে একটা প্রতিবাদ ওঠে। তবে যখন তেলেগু, মণ্ডা, সাঁওতাল কিংবা পাহাড় ও সমতলের আদিবাসী এবং সরকারি সম্পত্তি দখল হয়, তখন প্রতিবাদ করার কেউ থাকে না। এর জন্য শক্ত আইন দরকার। তবে সেই আইনটা তড়িঘড়ি করে এমনভাবে করা ঠিক হবে না, যাতে আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে দখলবাজরা পার পেয়ে যায় কিংবা সাজাটা মওকুফ হয়।
এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, প্রস্তাবিত আইনটি সারাদেশের জন্য প্রযোজ্য হবে বলা হয়েছে। যেসব আইন সারাদেশে প্রযোজ্য হওয়ার কথা বলা আছে, সেটি সারাদেশেই প্রযোজ্য হবে। তবে কিছু আইন আছে যাতে লেখা আছে, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান বাদে দেশের অন্যান্য জেলার জন্য প্রযোজ্য হবে। যেহেতু এই আইনে এ রকম কিছু লেখা নেই, সেহেতু ধরে নেওয়া যায়, এই আইন পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার জন্যও কার্যকর হবে। যদি তাই-ই হয়, তবে পার্বত্য শান্তি চুক্তির কী হবে? এই চুক্তির আওতায় যেসব পরিষদ এবং আইন হয়েছে, এর কী হবে? পার্বত্য ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের কী হবে? পার্বত্য চুক্তি যাতে বাস্তবায়িত না হয় এবং সেখানকার বাসিন্দাদের যাতে উচ্ছেদ করা যায়, এই আইনটি তার একটা উদ্যোগ।
মূল প্রবন্ধে মিনহাজুল হক চৌধুরী এই আইনের বিভিন্ন সংজ্ঞা এবং ধারা-উপধারার বিভিন্ন নেতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরেন। তিনি বলেন, এই আইনে যেসব সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, তাতে এ আইনকে পরিপূর্ণ ও সঠিকভাবে জনকল্যাণে কার্যকর করা সম্ভব হবে না। এই আইনের ৪ থেকে ২৮ নম্বর ধারা পর্যন্ত অপরাধ ও দণ্ডের কথা বলা হয়েছে। যদি ৪ নম্বর ধারার কথাই বলি, তাহলে এ ধারায় জাল দলিলের কথা বলা হয়েছে। তবে এ সম্পর্কে আইনে সুস্পষ্ট কোনো ধারণা দেওয়া হয়নি। জাল দলিলের বিরুদ্ধে প্রতিকারের জন্য সুনির্দিষ্টভাবে ‘রিলিফ অ্যাক্ট’-এর ৩৯ ধারায় বলা আছে। এই ধারায় অনেক মামলার নিষ্পত্তি হচ্ছে। অন্যান্য আইনেও এ বিষয়ে মামলা করা যায়। এ ছাড়া ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৪৬৫, ৪৬৬, ৪৬৭, ৪৬৮ এবং ৪৬৯ ধারায় জাল দলিলের বিষয়ে শাস্তির বিধান রয়েছে। এতে সর্বনিম্ন শাস্তি ২ বছর এবং সর্বোচ্চ শাস্তি ১০ বছর। প্রস্তাবিত আইনে এ অপরাধকে বড় অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও এর সাজা ১০ বছর থেকে কমিয়ে দুই বছর করা হয়েছে। এর উদ্দেশ কী? এটি ছাড়াও প্রস্তাবিত আইনের এমন অনেক ধারা আছে, যা কোনো আইনে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যোগ্যতা রাখে না। যাঁরা এটি করেছেন, তাঁদের আইন সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই। এই আইনের উদ্দেশ্যই হলো ভূমি আইনকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের আওতায় নেওয়া। এটি বিচার বিভাগের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী তবারক হোসেন বলেন, এ আইনের খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে আমলাতন্ত্রকে শক্তিশালী করার জন্য। পাকিস্তানি আমলে যখন আমাদের রাজনীতিবিদরা বক্তব্য দিয়েছেন, তখন সবাই লালফিতার দৌরাত্ম্যের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। সেই লালফিতার দৌরাত্ম্য বলতে তাঁরা আমলাতন্ত্রকেই বুঝিয়েছেন। তবে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ভোটে ক্ষমতায় আসার পর তাঁরা সেই আমলাতন্ত্রের কাছে আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়েছেন। সেই আমলাতন্ত্র তাঁদের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে আজ ‘দুঃসাহসিক চেষ্টা’র অংশ হিসেবে এ আইন প্রচলনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
ব্যারিস্টার আশরাফ আলী বলেন, ভূমিসংক্রান্ত যতগুলো বিরোধ আমাদের মধ্যে হয়ে থাকে, সবক’টি বিরোধই অপরাধের মধ্যে পড়ে না। কিছু আছে অপরাধ, কিছু আছে বিরোধ। বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য দেওয়ানি আদালত রয়েছে। অপরাধের ক্ষেত্রে পেনাল কোড রয়েছে, যার আওতায় বিচার করা হয়। তবে প্রস্তাবিত আইনে বিরোধগুলোকেও অপরাধের মধ্যে সংজ্ঞায়িত করে বিরোধকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং এর জন্য শাস্তির বিধান করা হয়েছে। সর্বোপরি বিরোধ ও অপরাধকে এ আইনে মিলিয়ে ফেলা হয়েছে।
নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের অধ্যাপক মো. রিজওয়ানুল ইসলাম বলেন, এই আইনের ভাষ্য অনুযায়ী যদি ধরে নেওয়া হয় যে, মামলাজট দূর করাই এই আইনের প্রধান উদ্দেশ্য। তাহলে আমরা পদ্ধতিগুলোর ওপর হাত দিচ্ছি না? আমরা কেন ‘কোড অব সিভিল প্রসিডিউর’ যা ১০০ বছর ধরে চলছে, সেখানে কেন আমরা সংশোধনীর কথা চিন্তা করছি না? বিচারকের অপ্রতুলতা যদি সমস্যা হয়ে থাকে, তাহলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের বদলে আরও বিভাগীয় বিচারকের সংখ্যা বাড়ানো যেতে পারে। একই সঙ্গে আমরা আইনের পদ্ধতিগত সংস্কার করতে পারি।
সভাপতির বক্তব্যে সুলতানা কামাল বলেন, প্রস্তাবিত এই আইনের নাম ‘ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন’ হলেও প্রতিকার ও প্রতিরোধ করার মতো শক্ত কোনো বিষয় এতে নেই। বরং যা কিছু আছে, সেটা অনেক বেশি অন্য পথে নিয়ে যাওয়ার একটা ব্যাপার আছে। সে জন্য এর উদ্দেশ্য, প্রক্রিয়া এবং সংজ্ঞাগুলো নিয়ে প্রশ্ন এসেছে। সবচেয়ে উদ্বিগ্নের বিষয় হলো– ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নির্বাহী থেকে বিচার বিভাগ আলাদা করার আমাদের যে আন্দোলন হয়েছিলে, এই আইনের মাধ্যমে তা নস্যাৎ হওয়ার পথে।
মন্তব্য করুন