১৯৭২ সাল। সদ্য স্বাধীন দেশে নব-প্রাণের জোয়ার বয়ে যাচ্ছে সর্বত্র। বিশেষ করে বলতে হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ছাত্রদের কথা। নব-জাগরণে সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে মুখর তারা। যেসব ছাত্র রণাঙ্গনে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন, তারা ফিরে এসে বিশ্ববিদ্যালয়কে মুখর করলেন সৃজনশীল কর্মে। ঢাবির কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের [ডাকসু] উদ্যোগে শুরু হয় নাটক নিয়ে অভূতপূর্ব এক উন্মাদনা। নতুন চিন্তা-ভাবনা থেকে নতুন নাটক রচনা, নির্দেশনা, মঞ্চায়ন, প্রদর্শন, আন্তঃহল নাট্য প্রতিযোগিতা এত কিছুর মধ্য দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, তথা ঢাকায় সৃষ্টি হয়েছিল মঞ্চনাটকের রেনেসাঁ। শুধু কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, ঢাকা শহর হয়ে এই রেনেসাঁ ছড়িয়ে পড়ল সারাদেশে। তৈরি হতে থাকল নতুন নাটকের দল। নতুন নাট্যভাবনা। সে এক আশ্চর্য সময়। মঞ্চনাটক নিয়ে ধুন্ধুমার কাণ্ড শুরু হয়ে গেল। ১৯৭৩ সালের ২৯ জুলাই একঝাঁক তেজি টগবগে সৃজনশীল তারুণ্যের সম্মিলনে প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা থিয়েটার। বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দীন ইউসুফ ছিলেন প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম এবং তাঁর নেতৃত্বেই সংগঠনটি সুসংগঠিত ও বিকশিত হতে থাকে। ১৯৭৩ সালে ঢাকা থিয়েটার মঞ্চে আনে ‘সংবাদ কার্টুন’, ‘সম্রাট ও প্রতিদ্বন্দ্বীগণ’। ১৯৭৪ সালে ‘জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন’, ‘বিদায় মোনালিসা’। এরপর ‘মুনতাসির’ [১৯৭৬], ‘চর কাঁকড়া’, ‘ফণিমনসা’ [১৯৭৭], ‘শকুন্তলা’ [১৯৭৮]। ঢাকা থিয়েটার খুব কম সময়ের মধ্যে তারুণ্যের শক্তিতে এবং সৃজনের অভিনবত্বে সবার দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হয়। হবেই বা না কেন? ঢাকা থিয়েটারের সঙ্গে যে যুক্ত হয়ে গেছেন সে সময়ের তুর্কি তরুণরা। সেলিম আল দীন, পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, আল-মনসুর, রাইসুল ইসলাম আসাদ, হাবিবুল হাসান, সাজেদুল আওয়াল, হুমায়ুন ফরীদি, আফজাল হোসেন, শিমূল ইউসুফ, সুবর্ণা মুস্তাফা, জহীরউদ্দিন পিয়ার, শহীদুজ্জামান সেলিমসহ আরও কত কত উজ্জ্বল মুখ।

 আশির দশকে এসে ঢাকা থিয়েটার যেন বর্ণে-গন্ধে-ছন্দে-গীতিতে দর্শকদের হৃদয়ে দোলা দিতে শুরু করল। কারণ ততদিনে নাসির উদ্দীন ইউসুফ আর সেলিম আল দীনের বোঝাপড়াটা পাকাপোক্ত হয়ে গেছে। এই দুই নাট্যকার-নির্দেশকের মণিকাঞ্চনযোগে মঞ্চে একের পর এক রচিত হতে থাকল নতুন ইতিহাস। ‘কিত্তনখোলা’, ‘কেরামত মঙ্গল’, ‘হাত হদাই’ কী অনন্য সাধারণ সব নাটক! বিশাল ক্যানভাসে নির্মিত দেশজ নাট্যের উপকরণ ও আঙ্গিকে বাংলা নাটক দেখা পেল নতুন দিগন্তের। এবার শুধু লক্ষ্য ঠিক রেখে এগিয়ে চলার পালা। না চলার ছন্দ এক হলে একঘেঁয়েমি চলে আসতে পারে। তাই দরকার নতুন ছন্দ, নতুন করণকৌশল। ‘কথানাট্য’ নামে নতুন নাট্য রচনারীতি সংযোজন করলেন সেলিম আল দীন। চাকা [নির্দেশনা: সৈয়দ জামিল আহমেদ], যৈবতী কন্যার মন [নির্দেশনা: নাসির উদ্দীন ইউসুফ], ‘হরগজ’ [নির্দেশনা: হুমায়ুন কবীর হিমু, সঙ্গে সম্ভবত একজন বিদেশি নির্দেশকও ছিলেন। এ নাটকটির অবশ্য নিয়মিত প্রদর্শনী হয়নি, তথ্যে বিভ্রাট থাকলে আগাম দুঃখ প্রকাশ করছি।]

নাট্যকার সেলিম আল দীন যেমন চেনা পথে বেশি হাঁটেননি, তাঁর শিল্পসঙ্গী নাসির উদ্দীন ইউসুফও তাই করেছেন। দু’জনই নতুন পথে হেঁটেছেন এবং একই সঙ্গে হেঁটেছেন। ইট-পাথর কাঁকরের পথে নয়, তাদের পথচলা ছিল বাংলার হাজার বছরের কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের পথে। ফলে ঢাকা থিয়েটারের প্রযোজনায় নতুনমাত্রা যুক্ত হতে থাকে নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে। দেশজ পাঁচালী, মঙ্গলকাব্যের আঙ্গিক আশ্রয়ে সৃষ্টি হতে থাকে বনপাংশুল, প্রাচ্য, ধাবমান প্রভৃতি নাট্য।

নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদীকূলবর্তী নামহীন, গোত্রহীন মানুষের সংগ্রামী জীবনের উপস্থাপনায় বাঙালির জাতীয় নাট্য আঙ্গিক নির্মাণ ছিল ঢাকা থিয়েটারের অভিপ্রায়। এই অভিপ্রায় থেকে ‘দেশজ মৌলিক নাটক মঞ্চায়নে’ অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন তারা। সেই অঙ্গীকার পূরণে তারা সফলও হয়েছেন। বাংলা নাটকের নিজস্ব অবয়ব রচনার যে চ্যালেঞ্জ তারা গ্রহণ করেছিলেন, তাতেও তাদের সাফল্য দেখতে পেয়েছিলাম আমরা। আবার এও ঠিক, সেলিম আল দীনের মৃত্যুর পর ঢাকা থিয়েটার তার ঔজ্জ্বল্য হারিয়েছে। তাদের প্রযোজনার সেই সৌকর্য আর আগের মতো খুঁজে পাওয়া যায় না। এমন কি তাদের প্রদর্শিত বর্ণনাত্মক রীতির নাটক পরে অনেকেই অনুসরণ ও চর্চা করার চেষ্টা করলেও তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই জগাখিচুড়িতে পরিণত হয়েছে। এর দায় ঢাকা থিয়েটারের না হলেও, তাদের দায়িত্ব রয়ে গেছে হাজার বছরের বাংলা নাটকের নিজস্ব আঙ্গিক অন্বেষণে আরও জঙ্গম ও শক্ত অবস্থান গ্রহণের মাধ্যমে। ‘দেশজ মৌলিক নাটক মঞ্চায়নে’র দীর্ঘ পথপরিক্রমায় তাদের কিঞ্চিৎ ব্যত্যয় হলেও ঢাকার মঞ্চ পেয়েছে ‘ধূর্ত উই’, ‘মার্চেন্ট অব ভ্যানিস’ এবং ‘দ্য টেম্পেস্ট’-এর মতো তিনটি নাটক। ‘ধূর্ত উই’-এ হুমায়ুন ফরীদির অসাধারণ অভিনয় আর দেশজ আঙ্গিকে নির্মিত ‘দ্য টেম্পেস্ট’ লন্ডনের বিশ্বখ্যাত শেকসপিয়র’স গ্লোব থিয়েটারে বাংলা ভাষায় মঞ্চায়ন তো বাংলা নাটককেই গৌরবান্বিত করেছে। ১৯৭৩ থেকে ২০২৩ সাল। এই ৫০ বছরের পথচলায় ঢাকা থিয়েটার বাংলা নাটককে দিয়েছে দু’হাত ভরে। অসংখ্য অসাধারণ নাটক তারা উপহার দিয়েছে ৫০ বছরে। বাংলা নাটকের ইতিহাসসমৃদ্ধ হয়েছে ঢাকা থিয়েটারের সৃজন সম্ভারে। আরও মঞ্চসফল অসংখ্য নাটকের প্রত্যাশা রইল জয়ন্তীর সুবর্ণরেখা অতিক্রমণকালে। জয়তু ঢাকা থিয়েটার। 


ফেরদৌসী মজুমদার

ঢাকা থিয়েটারের সঙ্গে আমার সম্পর্ক অনেক পুরোনো। শুরু থেকেই এর প্রায় সব সদস্যের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক। প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর উদযাপন উপলক্ষে প্রথমেই দলটিকে শুভেচ্ছা জানাই। একটা কিছু ভালো হতে থাকলে এটি সংক্রামকের মতো ছড়িয়ে পড়ে। ভালো সিনেমা হচ্ছে। ভালো ভালো নাটক হচ্ছে। ভালো দর্শক আসছে। মনে হয় যেন ভালোর জোয়ার এসেছে। ভালো লাগছে। সামনে আসছে ঢাকা থিয়েটারের সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব। সবাই মাতবে আনন্দে। এটি সফল হলে দলের এ রকম উৎসব আমরা আরও পাব। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীকে সফল করতে ঢাকা থিয়েটারের সদস্যরা দু’মাস ধরে পরিশ্রম করছেন। একেবারে মনে-প্রাণে সবার সাফল্য কামনা করছি। v


মামুনুর রশীদ

অনেক চ্যালেঞ্জিং কাজ করেছে ঢাকা থিয়েটার। দলটি সত্তরের দশকের শেষে এবং আশির দশকের গোড়ায় অনেক ভালো ভালো নাটক আমাদের উপহার দিয়েছে। এখনও তো তারা ভালো ভালো নাটক করে চলেছে। এটি একঝাঁক শিল্পী-কুশলী তৈরি করেছে গত ৫০ বছরে। দলের অনেকেই আজ প্রতিষ্ঠিত অভিনয়শিল্পী। নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের মৃত্যুতে দলটি এক বড় সংকটে পড়েছিল। ঢাকা থিয়েটারে যে নাট্যচর্চা শুরু করেছিলেন, তাঁর অনুপস্থিতিতে সেটি একটু হলেও ব্যাহত হয়েছে। এখন তাদের পছন্দমতো নাটক পাচ্ছে না দলটি। এটি একটি বড় সংকট। এ সংকট কাটিয়ে উঠতে চেষ্টা করছেন সদস্যরা। ঢাকা থিয়েটার দীর্ঘদিন বেঁচে থাকুক– এ কামনা করছি। v


সৈয়দ সালাহউদ্দীন জাকী 

ঢাকা থিয়েটারের সঙ্গে আমার সম্পর্ক গভীর। এর অন্তঃপ্রাণ নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যমণি এ মানুষটির হাত ধরে দলটি এগিয়ে চলছে। এখনও চোখে জ্বলজ্বল করছে যুদ্ধদিন। সারাদেশে যুদ্ধ চলছে। এত কিছুর মধ্যে কবে নাটক করবে তা নিয়ে উদগ্রীব থাকত বাচ্চু। বলত, জাকী ভাই আর কত দিন? কবে আমরা নাটক করব। এত বড় একটি দল। ঢাকা থিয়েটার ভাঙেনি কখনও। দু’ভাগ, তিন ভাগ হয়নি। সদস্যদের আন্তরিকতার কারণেই এটি সম্ভব হয়েছে। মামুনুর রশীদ, রামেন্দু মজুমদারসহ অনেকেই দলটিকে শুরু থেকে সাপোর্ট দিয়েছেন। ঢাকা থিয়েটার বাইরের দেশের কোনো লেখকের নাটক করেনি। সবই নিজস্ব নাটক। নাটকগুলোতে মাটির গন্ধ আছে। জীবনের নাটক।