নিঃশ্বাসে সিসার বিষ
মহাবিপদের তথ্যেও কারও টনক নড়ে না
রাজধানীর পাশে একটি অনুমোদনহীন সীসাযুক্ত ব্যাটারি রিসাইক্লিং কারখানা। ফাইল ছবি
জাহিদুর রহমান
প্রকাশ: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৪:৫৫ | আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৫:০০
২০১৯ সালে বাংলাদেশে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ রান্নায় ব্যবহৃত হলুদে ক্ষতিকারক সিসার উপস্থিতি পায়। তখন এ নিয়ে নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। কিন্তু কিছুদিন পার হতেই তা থেমে যায়। ধীরে ধীরে নানাভাবে জীবনের সঙ্গে আরও বেশি জড়িয়ে পড়তে থাকে সিসা। বর্তমানে শহরে-গ্রামে হাজার হাজার সিসা কারখানা পরিচালিত হচ্ছে। খাবার ও পণ্যে সিসার ব্যবহার মাত্রা ছাড়িয়েছে। প্লাস্টিক-সিরামিকের পাত্র, রং, শুকনো খাবার, খেলনা, রান্নায় ব্যবহৃত মসলা এবং প্রসাধনপণ্যের পাশাপাশি মাছ-মাংসেও মিলছে সিসা। নিঃশ্বাসের সঙ্গেও ঢুকছে সিসার বিষ।
দেশের খাদ্যপণ্যে সিসার উপস্থিতি নিয়ে ২০১৫ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সাতটি গবেষণায় উঠে এসেছে উদ্বেগজনক তথ্য। কেবল মানুষই নয়, সিসার বিষে মারা যাচ্ছে গরুর মতো প্রাণীও। সিসাযুক্ত খাবার খেয়ে গত বছর গাজীপুরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে একসঙ্গে মারা গেছে ১১টি জেব্রা।
সর্বশেষ গত মঙ্গলবার প্রকাশিত হয় ‘গ্লোবাল হেলথ বার্ডেন অ্যান্ড কস্ট অব লেড এক্সপোজার ইন চিলড্রেন অ্যান্ড অ্যাডাল্টস: এ হেলথ ইমপ্যাক্ট অ্যান্ড ইকোনমিক মডেলিং অ্যানালাইসিস’ শিরোনামের বিশ্বব্যাংকের গবেষণা প্রতিবেদন। এতে বলা হয়, সিসা দূষণে দেশে বছরে হৃদরোগে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৫৪ মানুষ মারা যাচ্ছে। গবেষণার অংশ হিসেবে খুলনা, রাজশাহী ও বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় ২০০টি নমুনা সংগ্রহ করে সিসার উপস্থিতি পরিমাপ করে দেখেছে নিউইয়র্কভিত্তিক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান পিওর আর্থ। এর মধ্যে ২৪ শতাংশ নমুনাতেই মাত্রাতিরিক্ত সিসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
একের পর এক এমন উদ্বেগজনক তথ্যের পরও সিসা দূষণ কমাতে নেওয়া হচ্ছে না কোনো ব্যবস্থা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিসার সম্ভাব্য উৎস বের করে তা বন্ধ করতে উদ্যোগ নেওয়া দরকার। রক্তে সিসার উপস্থিতি আছে কিনা, তা নিয়মিত নজরদারি করা জরুরি। আইনের কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি জনসচেতনতাই পারে সিসার বিষ থেকে মানুষকে বাঁচাতে। সিসা দূষণ প্রতিরোধে গঠিত লেড-সেফ বাংলাদেশ কোয়ালিশনের সদস্যরা এ খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন।
গবেষণায় উদ্বেগজনক তথ্য
২০২১ সালে জার্নাল অব হেলথ অ্যান্ড পলিউশনে প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে রাজধানীর কারওয়ান বাজার থেকে সংগৃহীত প্রতি কেজি পাঙাশ মাছে ৩০.৮ মাইক্রোগ্রাম, রুই মাছে ১৫.৩৩ মাইক্রোগ্রাম ও কাতলা মাছে ১৫.৮৬ মাইক্রোগ্রাম সিসার উপস্থিতি পাওয়া যায়। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) ও যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০১২-১৩ সালের দিকে বাংলাদেশের ৯টি জেলায় অন্তঃসত্ত্বাদের রক্তে সিসার পরিমাণ মাত্রার চেয়ে বেশি পাওয়া যায়। পরে সংস্থাটি এ সিসার উৎস খোঁজার জন্য নানা ধরনের নমুনা সংগ্রহ করে। পরে হলুদে সিসার মিশ্রণ খুঁজে পায় তারা।
২০২২ সালে প্রকাশিত রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এবং আইসিডিডিআর,বির গবেষণায় বলা হয়, দেশের সাড়ে তিন কোটির বেশি শিশু শরীরে ক্ষতিকারক সিসা বয়ে বেড়াচ্ছে। দুই থেকে চার বছর বয়সী শিশুদের শতভাগের শরীরে সিসার উপস্থিতি মিলেছে। গবেষণায় বাজারের বিভিন্ন পণ্যও পরীক্ষা করা হয়। ৩৬৭টি পণ্যে পরীক্ষা চালিয়ে ৯৬টিতে সিসার উপস্থিতি মিলেছে। চারটি শহরে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত খেলনা, রং, অ্যালুমিনিয়াম ও সিলভারের হাঁড়িপাতিল, সবজি, চাল এবং মসলার নমুনায় সিসার উপস্থিতি পাওয়া যায়।
২০১৭ সালে ফিশারিজ অ্যান্ড এগ্রিকালচার জার্নালে প্রকাশিত আরেক গবেষণায় ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা বাজারে তেলাপিয়া মাছে সর্বোচ্চ ১৬.৩৮৬ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত সিসা পাওয়া যায়।
বিষমুক্ত করার পথ কী
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিসার সবচেয়ে বড় উৎস পরিত্যক্ত ব্যাটারি। এ ছাড়া ভবনে রঙের উজ্জ্বলতা বাড়াতে, গাছের পাতায় কীটনাশকের স্থায়িত্ব বাড়াতে, ডাইং হাউসের কাপড়ের রঙে এবং কলকারখানা থেকে নানা মাধ্যমে সিসা নদীতে পৌঁছায়। পরে সেটি মাছসহ নদীর প্রাণীদের খাদ্যে পরিণত হচ্ছে, যা শেষ পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে মানুষের পেটে।
১৯৯৯ সালে রাজধানীর একটি ক্লিনিকে প্রতিবন্ধী ও কম মনোযোগী শিশুদের রক্ত পরীক্ষা করে মাত্রাতিরিক্ত সিসা পাওয়া যায়। তখন এ তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশের পর সরকার সিসাযুক্ত পেট্রোল ব্যবহার বন্ধ করে দেয়। বাংলাদেশে সিসাদূষণ বন্ধে মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয় নিশ্চিত করে অগ্রসরের বিষয়ে জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
পিওর আর্থের বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ড. মাহফুজার রহমান, বলেন, আমরা হয়ত সিসা খালি চোখে দেখি না। তবে সিসা একটি শিশুর স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং বিকাশের উপর ধ্বংসাত্মক পরিণতি ডেকে আনে।
এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসডো) মহাসচিব ড. শাহরিয়ার হোসেন বলেন, মানদণ্ড থাকা সত্ত্বেও ডেকোরেটিভ এবং শিল্প খাতে ব্যবহৃত পেইন্টগুলোতে এখনও উচ্চ মাত্রার সিসা পাওয়া যায়। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুরক্ষার জন্য আইনের প্রয়োগ, শিল্প খাতে ব্যবহৃত রঙের মান উন্নয়ন এবং দূষণকারীদের জরিমানার আওয়াত আনতে হবে।
আইসিডিডিআর,বির সংক্রামক রোগ বিভাগের প্রকল্প সমন্বয়ক ড. মাহবুবুর রহমান বলেন, নানা গবেষণা ও সংগৃহীত প্রমাণ আমাদের বাংলাদেশে সিসাদূষণের মাত্রা উপলব্ধি করতে সাহায্য করেছে। গবেষণা থেকে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত কাজে লাগিয়ে সিসাদূষণ প্রতিরোধে কার্যক্রম হাতে নেওয়ার এখনই সময়।
বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি শেলডন ইয়েট বলেন, জাতীয় পর্যায়ে নজরদারি বাড়ানো দরকার। সিসাদূষণের শিকার গৃহস্থালিগুলো মূল্যায়ন করে উৎস এবং উপযুক্ত কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন প্রয়োজন।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, গবেষণায় যে তথ্য উঠে এসেছে, তা বেশ উদ্বেগজনক। আমাদের এখনই কাজ শুরু করতে হবে। ছোট ছোট বাচ্চারা ভিকটিম। আমরা তাদের ধ্বংস করে দিচ্ছি। ক্ষতির মুখে ঠেলে দিচ্ছি। এখানে পরিবেশ অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পলিসি লেভেলে কাজ করতে হবে। ফরমালিনের ক্ষেত্রে পলিসি হয়েছে, নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। সময় এসেছে সিসাকে নিয়ন্ত্রণের।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বলেন, ক্ষতিকর সিসাদূষণকে নারী-শিশুসহ সাধারণ মানুষকে বাঁচাতে সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তর প্রায়ই অবৈধ ব্যাটারি উৎপাদন এবং পুনর্ব্যবহারের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করছে। শুধু আইন প্রয়োগই কাঙ্ক্ষিত ফলাফল আনতে পারে না। ব্যাপক সচেতনতা প্রয়োজন।