জমি অধিগ্রহণের টাকায় নজর

নড়িয়ার মাঝিরহাট বাজারের এ স্থাপনায় এক সময় ছিল ইউনিয়ন বিএনপির কার্যালয়। এটিকেও দেখানো হয়েছে মাদ্রাসার স্থাপনা হিসেবে। ছবি-সমকাল
সোহাগ খান সুজন, শরীয়তপুর
প্রকাশ: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৮:০০
পদ্মা সেতু সংযোগ সড়কের জন্য জমি অধিগ্রহণের টাকা হাতিয়ে নিতে অভিনব কৌশল নিয়েছে একটি চক্র। শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার কয়েক ব্যক্তি ভিন্ন তিন দাগের ৩৪ শতাংশ জমিকে একটি মাদ্রাসার নামে বিআরএস রেকর্ড করিয়েছেন। অস্তিত্বহীন ওই মাদ্রাসার ভবন হিসেবে দেখানো হয়েছে এক ব্যক্তির গুদামঘর ও স্থানীয় বিএনপির বন্ধ হয়ে যাওয়া একটি কার্যালয়কে। এভাবে জমি অধিগ্রহণ প্রকল্পের ৪৬ লাখ ৭৫ হাজার ৭৫৮ টাকা আত্মসাতের পাঁয়তারা করছে চক্রটি।
ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসকের এলএ শাখা থেকে তাদের হাতে পৌঁছে গেছে অধিগ্রহণের ৮ ধারার নোটিশ। বিষয়টি নিয়ে এলাকায় আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। জমির মালিকরা বিষয়টি সুষ্ঠুভাবে তদন্তের দাবি জানিয়েছেন।
ঘটনাটি নড়িয়া উপজেলার নশাসন ইউনিয়নের মাঝিরহাট এলাকার। জেলা প্রশাসন সূত্র ও সরেজমিন জানা গেছে, জেলার জাজিরা উপজেলার নাওডোবা প্রান্ত থেকে জেলা শহর পর্যন্ত নির্মিত হবে ২৭ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতুর সংযোগ সড়ক। এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৬৮২ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। এর জন্য অধিগ্রহণ করা হচ্ছে ১০৫ দশমিক ৫ হেক্টর জমি। এ প্রকল্পের জন্য সড়ক বিভাগের প্রস্তাবে এল.এ কেসের মাধ্যমে জমি ও স্থাপনা অধিগ্রহণ শুরু করেছে জেলা প্রশাসন। সে জন্য যৌথ তদন্ত শেষে জেলা প্রশাসন, গণপূর্ত বিভাগ এবং বন বিভাগ ৭ ধারার নোটিশ দিয়েছে জমি ও স্থাপনা মালিকদের। সম্প্রতি নড়িয়া উপজেলার নশাসন গাগ্রীজোড়া, ডগ্রীসহ কয়েকটি এলাকায় ৮ ধারার নোটিশ দেয় জেলা প্রশাসন।
স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণের আওতায় পড়েছে মাঝিরহাটের ২৩ নম্বর নশাসন মৌজার ৬ নম্বর খতিয়ানের বিআরএস (বাংলাদেশ রিজিওনাল সার্ভে) রেকর্ডভুক্ত ৩৪ শতাংশ জমি। ৩৩০৩, ৩৩০৪ ও ৩৩০৫ নম্বর দাগের জমিটি ওই রেকর্ডে অস্তিত্বহীন একটি মাদ্রাসার (ইবতেদায়ি স্বতন্ত্র মাদ্রাসা) নামে। কীভাবে সেটি রেকর্ড করা হয়েছে, এ বিষয়ে দলিলপত্র পাওয়া যায়নি।
৩৩০৫ নম্বর দাগসহ আরও কয়েকটি দাগের সম্পত্তি এসএ রেকর্ড অনুযায়ী পৈতৃক মালিকানা দাবি করেন স্থানীয় আব্দুল খালেক বেপারি। তিনি ২০১৯ সালে জেলা প্রশাসক ও অস্তিত্বহীন মাদ্রাসাসংশ্লিষ্ট পাঁচজনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন। খালেকের মৃত্যুর পর তা চালিয়ে নেন স্ত্রী নিলুফা বেগম। তাঁর ভাষ্য, ৩৩০৫ নম্বর দাগের জমিতে নশাসন ইবতেদায়ি মাদ্রাসার কোনো ঘর নেই। সরেজমিন তদন্ত করলে এর অস্তিত্বও খুঁজে পাবেন না। ওই জায়গাটি তাঁর স্বামী খালেক বেপারির নামে।
৮ ধারার নোটিশ দেওয়ার পর নিলুফা বেগম ৩১ আগস্ট মামলার আরজি অনুযায়ী অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আদালতে আবেদন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে আদালত পাঁচ বিবাদীকে ১০ দিনের মধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন।
৮ ধারার নোটিশে মাদ্রাসার নামে স্থাপনা হিসেবে দেখানো হয়েছে ৩৩০৫ নম্বর দাগের একটি ক্লাবঘরকে। বিএনপি ক্লাব হিসেবে পরিচিত ঘরটি আনুমানিক এক শতাংশ জমির ওপর। এখানে একসময় ইউনিয়ন বিএনপির কার্যালয় ছিল। দীর্ঘদিন ধরে সেটি বন্ধ। জমিটি ক্লাবের মালিকানায় থাকলেও সংশ্লিষ্টদের কেউ নোটিশ পাননি। এর দক্ষিণ পাশে আব্দুল খালেক বেপারির একটি বাগান।
বাগানের পাশেই বাজারে আব্দুল জলিল মাঝির মালিকানাধীন ২ শতাংশ জমিতে একটি গুদামঘর। এটিকেও ৮ ধারার নোটিশে মাদ্রাসার স্থাপনা দেখানো হয়েছে। জলিল মাঝির মৃত্যুতে জমিটির উত্তরাধিকারী তাঁর স্ত্রী ফেরদৌস জাহান, মেয়ে লায়লা জিয়াসমিন ও বোন জাহানারা বেগম। তাদের কারও নামে ওই নোটিশ আসেনি।
লায়লা জিয়াসমিন বলেন, ‘নশাসন মাঝিরহাট বাজারের ওই গুদামঘরের মালিক আমরা। গ্রামে না থাকায় ওই ঘরটি মাদ্রাসার নামে দেখানো হয়েছে।’ তবে কীভাবে এটি করা হয়েছে তা বুঝতে পারছেন না ওই পরিবারের সদস্যরা।
স্থানীয় লোকজনের অভিযোগের তীর নশাসন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান কামরুল আহসান মাঝি ও কথিত মাদ্রাসা কমিটির সভাপতি গোলাম মোস্তফা মাঝির দিকে। তারা বলছেন, ওই দু’জনই গুদামঘর ও ক্লাবের ভবন মাদ্রাসার স্থাপনা হিসেবে দেখিয়ে সরকারি টাকা আত্মসাতের পাঁয়তারা করছেন। সুষ্ঠু তদন্ত করলে এ বিষয়ে অনিয়মের বিষয়টি ধরা পড়বে।
ওই এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ সরদার (৮০)। তিনি প্রায় ৫০ বছর আগে কিছু শিশুকে ওইখানের মক্তবে পড়তে দেখেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা তো জানি জায়গাটি মৃত খালেক বেপারির। এখানে তো কোনো মাদ্রাসা ছিল না!’
জীবদ্দশায় কোনো মাদ্রাসা সেখানে দেখেননি আরেক বাসিন্দা মোসলেম ঢালী (৯০)। তিনি বলেন, এখানে অতীত-বর্তমান কোনোকালেই মাদ্রাসা ছিল না। মাদ্রাসার নামে স্থাপনা ও বরাদ্দ কীভাবে হলো তা সংশ্লিষ্ট লোকজনই ভালো জানেন।
ইবতেদায়ি স্বতন্ত্র মাদ্রাসা কমিটিতে সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে চুন্নু মাঝিকে। তিনিও ৮ ধারার নোটিশ সম্পর্কে কিছু জানেন না। স্থানীয় একটি মসজিদ কমিটির সাধারণ সম্পাদক চুন্নু মাঝির ভাষ্য, ‘গোলাম মোস্তফা মাঝি আমাকে মাদ্রাসা কমিটির সাধারণ সম্পাদক করেছেন। তিনি (মোস্তফা) সভাপতি আর আমি সাধারণ সম্পাদক। এ ছাড়া কমিটিতে আর কেউ আছে বলে জানি না।’
ওই মাদ্রাসা কমিটির স্বঘোষিত সভাপতি গোলাম মোস্তফা মাঝি বলেন, ‘আমরা মাদ্রাসা ভবনের ভূমি অধিগ্রহণের জন্য ৮ ধারার নোটিশ পেয়েছি। ওই তিনটি দাগের জমিই মাদ্রাসার নামে।’ সেখানকার পাকা ঘরটিকেই মাদ্রাসা হিসেবে দাবি করেন তিনি। আরও দাবি করেন, ‘ছাত্রছাত্রীরা এখন পড়তে আসে না বলে পাকা ঘরটি ভাড়া দিয়ে দিয়েছি।’
সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান কামরুল আহসান মাঝি এ বিষয়ে জড়িত থাকার অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দেন। তিনি বলেন, ক্লাবঘর ও গুদামঘর ভবনের ৮ ধারার নোটিশ মাদ্রাসার নামে হয়েছে। কীভাবে এটা হয়েছে তা মাদ্রাসার সভাপতি ভালো বলতে পারবেন।
জমির মালিকানা বা মূল্য জেলা প্রশাসনের অধিগ্রহণ শাখা নির্ধারণ করে। গণপূর্ত বিভাগকে স্থাপনার বর্ণনা সরবরাহও করে তারা। সে অনুযায়ী দাম নির্ধারণ করা হয় বলে জানান শরীয়তপুর গণপূর্ত অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মহিবুর রহমান পিইঞ্জ। তিনি বলেন, সব স্থাপনার সরেজমিন তদন্ত সম্ভব হয় না। কিন্তু ৯০-৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রে সরেজমিন তদন্ত করেন। জেলা প্রশাসন কোনো স্থাপনার বিষয়ে পুনর্তদন্তের নির্দেশ দিলে তারা করতে প্রস্তুত।
জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ নিজাম উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, নশাসন ইবতেদায়ি স্বতন্ত্র মাদ্রাসার অস্তিত্ব না থাকলে বিল পাবে না। রেকর্ডটি গ্রহণযোগ্য দলিলের। জমি নিয়ে যদি আদালতে মামলা থাকে, তবে তা নিষ্পত্তি হওয়ার পর প্রকৃত মালিককে ন্যায্য মূল্য দেওয়া হবে।
- বিষয় :
- জমি অধিগ্রহণ
- পদ্মা সেতু সংযোগ সড়ক
- টাকা