
রিদ্ধিমান রাজ
হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে বাবা প্রবীর বারিকের কাছে ‘অরেঞ্জ জুস’ খাওয়ার বায়না করেছিল আট বছরের রিদ্ধিমান রাজ। কিন্তু জুস শেষ হয়ে গিয়েছিল; তৎক্ষণাৎ এনে খাওয়ানোর মতো পরিস্থিতিও ছিল না। সে সময় কর্তব্যরত নার্স তাকে আনারের জুস খাওয়ান। প্রবীর তখনও বুঝতে পারেননি, তাঁর একমাত্র ছেলে আর এক দিন পৃথিবীতে আছে। তাই রিদ্ধিমানের মৃত্যুর পর তাঁর ইচ্ছানুযায়ী ‘অরেঞ্জ জুস’ খাওয়াতে না পারার আক্ষেপে পুড়ছেন তিনি।
ডেঙ্গু আক্রান্তের আট দিন পর গত ১১ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রিদ্ধিমান মারা যায়। সে প্রকৌশলী প্রবীর বারিক ও শিক্ষক বৃষ্টির একমাত্র সন্তান। তাঁদের বাড়ি বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার চরদুয়ানী গ্রামে। চরদুয়ানী কেওড়াতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বৃষ্টি। বাড়ির পাশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল রিদ্ধিমান। মাকে ছাড়া সে কোনোদিন একা থাকেনি। তার মৃত্যুতে বৃষ্টির চোখের পানি অঝোরে ঝরছে। ছেলে হারানোর শোকে কাঁদতে কাঁদতে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা এই শিক্ষক। হারমোনিয়াম-তবলা নিয়ে মেতে থাকা রিদ্ধিমান নেই। বৃষ্টির ঘরজুড়ে এখন শুধুই নীরবতা।
প্রবীর ঢাকায় একটি কোম্পানিতে প্রকল্প প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত। স্ত্রী-সন্তানকে দেখতে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বরগুনায় ছুটে যেতেন। ছেলের শেষ সময়ের কথাগুলো তাঁর মাথা থেকে সরছে না। প্রবীর বারিক সমকালকে বলেন, রিদ্ধিমান বলছিল, ‘বাবা বাড়ি যাব। আমাকে বাড়ি নিয়ে যাও। এখানে (হাসপাতালে) ভালো লাগছে না।’ তার এই কথাগুলো সবসময় কানে বাজছে। তাকে বাড়িতে নিয়ে আসলাম ঠিকই, কিন্তু মৃত।
তিনি জানান, গত ৪ সেপ্টেম্বর রাতে রিদ্ধিমানের জ্বর আসে। জ্বর না কমায় চিকিৎসকের পরামর্শে ফার্মেসি থেকে সাপোজিটর দেওয়া হয়। এরপরও জ্বর কমছিল না। পরদিন স্বাস্থ্য পরীক্ষায় তার ডেঙ্গু ধরা পড়ে। শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে ৬ সেপ্টেম্বর ভোরে তাকে বরিশাল সদরের একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ততক্ষণে প্রবীর ঢাকা থেকে বরিশালে পৌঁছে গেছেন। সেদিনের পরীক্ষায় জানা যায়, রিদ্ধিমানের রক্তে প্লাটিলেট ১ লাখ ৪০ হাজার। কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে আরেকটি পরীক্ষায় দেখা যায়, প্লাটিলেট ৬৫ হাজারে নেমেছে। তাই দেরি না করে রিদ্ধিমানকে নিয়ে পরদিন ঢাকায় রওনা দেন প্রবীর। ৮ সেপ্টেম্বর ভর্তি করেন ইউনাইটেড হাসপাতালে। সেখানে পরীক্ষায় দেখা যায়, প্লাটিলেট ১৮ হাজার। পরদিন আরও কমে ৭ হাজারে দাঁড়ায়। দ্রুত চার ব্যাগ প্লাটিলেট দেওয়া হয়। তখন প্লাটিলেট বেড়ে দাঁড়ায় ৫১ হাজারে। ১০ সেপ্টেম্বর বাবার সঙ্গে শেষবার কথা বলে বাড়িতে ফেরার ইচ্ছার কথা জানায় রিদ্ধিমান। সেই সঙ্গে অরেঞ্জ জুস খেতে চায়।
চিকিৎসকরা জানান, ডেঙ্গুতে রিদ্ধিমানের ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সে সময় থেকে রক্তচাপ কমতে থাকে। রক্তক্ষরণ শুরু হয়। খিঁচুনি হলে চিকিৎসকরা লাইফ সাপোর্টে নেওয়ার কথা জানান। কিন্তু প্রবীর তাতে রাজি ছিলেন না। কারণ তখন অক্সিজেনের মাত্রা ছিল ৯০ শতাংশ। ১১ সেপ্টেম্বর ভোরে রিদ্ধিমানকে প্লাটিলেট দেওয়ার কথা জানান চিকিৎসক। রক্তও জোগাড় হয়েছিল। কিন্তু সকাল পৌনে ৯টায় তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা।
প্রবীর বারিক বলেন, ‘আমার ছেলে মেধাবী ছিল। এ বছর মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে। তার মুখে সবসময় হাসি লেগে থাকত। তিন বছর বয়স থেকেই হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইত। তবলা বাজাতে পারত। ছবি আঁকারও নেশা ছিল। এ কারণে গত বছর অনলাইনে কোর্স করিয়েছি। দারুণ সব ছবি আঁকত আমার রিদ্ধিমান। এখন ঘরজুড়ে নীরবতা। সবকিছু পড়ে আছে। কে বাজাবে হারমোনিয়াম? কে বাজাবে তবলা? মাকে ছাড়া কখনও থাকত না। সেই মানিক আমার তার মাকে ছাড়া আছে অনন্তলোকে। ডেঙ্গু আমাদের সব তছনছ করে দিল।’
রিদ্ধিমান রাজের মৃত্যুতে বিদ্যালয়েও শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তার বিদ্যালয়সহ আশপাশের কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যানার টানিয়ে শোক প্রকাশ করা হয়েছে। এক দিনের ছুটি ঘোষণা করে তাঁর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চরদুয়ানী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
মন্তব্য করুন