- বাংলাদেশ
- যার ভোট সে যেন দিতে পারে
সাক্ষাৎকার: কামাল উদ্দিন আহমেদ
যার ভোট সে যেন দিতে পারে
বিদেশি রাষ্ট্র ও সংস্থার বিবৃতি প্রভাবিত

বিদেশি রাষ্ট্র ও সংস্থাগুলো দেশের ব্যক্তি বা সংগঠন দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মানবাধিকার সুরক্ষার নামে বিবৃতি দেয় বলে মনে করেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমেদ। তাঁর মতে, অধিকারের সম্পাদক আদিলুর রহমান শুভ্র ও পরিচালক এএসএম নাসির উদ্দিন এলানকে বিচারব্যবস্থার মাধ্যমে সাজা দেওয়ার পরও যেসব দেশ বা ব্যক্তি এ নিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন, তারা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার অপপ্রয়াস চালাচ্ছেন। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের কথা বলা উচিত।
সমকালকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন সংস্থাটির চেয়ারম্যান। তিনি আরও বলেন, দেশে আগামী নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতার ঘটনা যাতে না ঘটে, সে লক্ষ্যে কমিশন কাজ করে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনেরও উচিত হবে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য ভোট ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, যাতে যার ভোট সে যেন দিতে পারে।
সমকাল: দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি কেমন– আপনার সার্বিক মূল্যায়ন জানতে চাই।
কামাল উদ্দিন আহমেদ : এক কথায় বললে সার্বিকভাবে মানবাধিকার পরিস্থিতি অবশ্যই ভালো। তবে বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করতে হলে অনেক বিষয় আসবে। বিশেষ করে মানবাধিকার-সংক্রান্ত জাতিসংঘের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রের ৩০টি অনুচ্ছেদ আছে। জাতিসংঘভুক্ত সব দেশকেই এগুলো বাস্তবায়ন করতে হয়। এখানে মানুষের ভালোর জন্য যা কিছু, সবই মানবাধিকার। এর ব্যত্যয় হলেই মানবাধিকারের লঙ্ঘন। আমাদের সংবিধানের ২৭ থেকে ৪৪ অনুচ্ছেদেও মানবাধিকারের বিষয়গুলো সুস্পষ্ট রয়েছে। এ হিসেবে পৃথিবীর কোনো দেশই মানবাধিকার লঙ্ঘন থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত নয়।
সমকাল: তাহলে আপনি কি মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে সন্তুষ্ট?
কামাল উদ্দিন আহমেদ: সন্তোষজনকই বলব। কিন্তু আপনি যদি নিত্যপণ্যের বাজার দেখেন তাহলে দেখবেন আলু, ডিম, পেঁয়াজসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। যদি মানবাধিকারের কথা বলেন তাহলে এই দাম বৃদ্ধিও মানবাধিকারের লঙ্ঘন। কারণ, চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি হওয়া সত্ত্বেও অনেক পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। এর জন্য দায়ী সিন্ডিকেট ব্যবসা। এই যে কারসাজি, সেটার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের কোটি কোটি মানুষ। এসবের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে মানবাধিকারের লঙ্ঘন হবে।
সমকাল: ২০ ও ২১ সেপ্টেম্বর ভারতে এশিয়া প্যাসিফিক ফোরামের দ্বিবার্ষিক সম্মেলন। বাংলাদেশ এবারের সম্মেলন থেকে কী অর্জন করতে চায়?
কামাল উদ্দিন আহমেদ: এই সম্মেলনের গুরুত্ব অনেক। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবজনিত ক্ষতির বিষয়টি তুলে ধরা হবে। কারণ, দেশের উপকূলীয় ১৯টি জেলার ৩ কোটি ৮০ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা নির্ভর করে উপকূলীয় বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে। জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে উপকূলীয় এলাকার জমি লবণাক্ত হয়ে যাচ্ছে। মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অর্থাৎ, মানবাধিকারের লঙ্ঘন হচ্ছে। এর জন্য উন্নত বিশ্ব দায়ী। এ ছাড়া সম্মেলনে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কার্যক্রমসহ অন্যান্য বিষয় সম্মেলনে তুলে ধরা হবে।
সমকাল : সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘দেশে মানবাধিকারকর্মীদের জন্য রাষ্ট্রীয় সংস্থা বড় বাধা হিসেবে কাজ করছে’– আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
কামাল উদ্দিন আহমেদ : অনুষ্ঠানে আমিও উপস্থিত ছিলাম। তাদের প্রতিবেদন দেখেছি এবং পর্যালোচনা করেছি। দেশের ৩৬টি জেলার তৃণমূল পর্যায়ের মাত্র ৫০ জন মানবাধিকারকর্মীর সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছিল। প্রতিবেদনে অনেক বিষয়ের ঘাটতি রয়েছে। কারণ, এখানে ভিন্ন পক্ষের কোনো মতের প্রতিফলন ঘটেনি।
সমকাল : দেশে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে, কোনো উদ্যোগ নেবেন কিনা?
কামাল উদ্দিন আহমেদ : আমরা ইতোমধ্যে নির্বাচন-পূর্ব, নির্বাচনকালীন এবং নির্বাচনোত্তর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। এ বিষয়ে কার্যক্রম চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়া এগিয়ে চলেছে। বিভাগীয় পর্যায়ে আমরা প্রশাসনসহ জনসাধারণকে নির্বাচনকালীন মানবাধিকার সুরক্ষায় সুসংগঠিত করতে চাই। কারণ, আমাদের অতীতের অভিজ্ঞতা রয়েছে, নির্বাচনকালে অনেক মানুষকে পঙ্গু করা হয়েছে, জীবনহানি করা হয়েছে। এগুলো যাতে না হয়, নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সেগুলোই আমাদের লক্ষ্য। আবারও বলব, অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য ভোট ব্যবস্থা যাতে হয়, যার ভোট সে যেন দিতে পারে, এটি নিশ্চিত করা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
সমকাল : সম্প্রতি ইউরোপীয় পার্লামেন্টে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।
কামাল উদ্দিন আহমেদ : মানবাধিকারের বিষয়টি অনেক বিস্তৃত। এর রাষ্ট্রীয় কোনো সীমারেখা নেই। পৃথিবীর যে কোনো দেশে যে কারও মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে যে কেউ কথা বলতে পারেন।
সমকাল : বিদেশি রাষ্ট্র ও সংস্থাগুলো বাংলাদেশের মানবাধিকারের বিষয়ে দেশের ব্যক্তি বা সংগঠন দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে বলে মনে করেন কিনা?
কামাল উদ্দিন আহমেদ : ক্ষেত্রবিশেষে তারা প্রভাবিত হচ্ছে। তাদের কাছে বাংলাদেশ থেকে যেসব তথ্য যায়, সেগুলো অনেকাংশেই সঠিক নয়।
সমকাল : যে কোনো রাজনৈতিক সহিসংতায় মানবাধিকারকর্মী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। এর কারণ কী?
কামাল উদ্দিন আহমেদ : অপরাধটি অনেক গুরুতর। প্রতিটি নির্বাচনে ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও মানবাধিকারকর্মীদের ওপর কিছু অপরাধের ঘটনা আমাদের সামনে আসে। এটি মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর যেসব সহিসংতার ঘটনা ঘটেছে, তার প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি।
সমকাল : গুজব ছড়ানোসহ কয়েকটি অভিযোগে মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের সম্পাদক ও পরিচালককে সাজা দিয়েছেন আদালত। এ ঘটনায় ফ্রান্সসহ কয়েকটি দেশ উদ্বেগ জানিয়েছে।
কামাল উদ্দিন আহমেদ : দেখুন, দেশগুলো বিবৃতি দিয়ে বলছে, মামলা বাতিল করে নিঃশর্তভাবে আদিলুর রহমান ও এলানকে মুক্তি দিতে হবে। এটা কীভাবে তারা বলে? একটি বিচারব্যবস্থার মাধ্যমে আসামিদের সাজা হয়েছে। বিবৃতিদাতারা তাদের অপরাধকে দেখছে না, মুক্তি চাচ্ছে। অথচ বিচারব্যবস্থায় তাদের আপিল করার সুযোগ রয়েছে। এখানে বিবৃতিদাতারা আসামিদের আইনি সহযোগিতা বা পরামর্শ দিতে পারেন। কিন্তু এ বিষয়গুলো নিয়ে তারা কথা বলছেন না। বরং রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার অপপ্রয়াস চালানো হচ্ছে।
সমকাল : বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুমসহ কিছু বিষয় নিয়ে বিদেশি রাষ্ট্র ও সংস্থাগুলো নানা রকম বিবৃতি দিয়ে থাকে। বর্তমানে সার্বিক পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে?
কামাল উদ্দিন আহমেদ : বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, হেফাজতে মৃত্যু– এগুলো সবই জঘন্য অপরাধ। এগুলো হওয়া উচিত নয়। এ ধরনের প্রতিটি অপরাধের ক্ষেত্রে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন দাঁড়াচ্ছে ও পাল্টা ব্যবস্থা নিচ্ছে। তবে এসব অপরাধ কখনও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু ব্যক্তির অতি উৎসাহের কারণে ঘটে। যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সম্পৃক্ততা থাকে না। কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে হচ্ছে, এটা বলা যাবে না।
সমকাল: আপনাকে ধন্যবাদ।
কামাল উদ্দিন আহমেদ: সমকালকেও ধন্যবাদ।
মন্তব্য করুন