- বাংলাদেশ
- রামুতে বাল্যবিয়ে রোধে পথ দেখাচ্ছে গার্ল শাইন
রামুতে বাল্যবিয়ে রোধে পথ দেখাচ্ছে গার্ল শাইন

প্রতীকী ছবি
কক্সবাজারের রামু উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সিভিয়ার একিউট ম্যালনিউট্রিশন (সাম) ইউনিটে চিকিৎসাধীন দশ মাস বয়সী আফসান। পাশেই তার ১৫ বছর বয়সী মা জেবুন্নেসা বসে আছেন। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির বাসিন্দা এই মা-ছেলে দু’জনই শীর্ণকায়। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকরা জানান, মূলত পাঁচ বছরের নিচের যেসব শিশু ভীষণ অপুষ্টিতে ভুগছে, তাদের এই ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। ১৪ দিন পর্যবেক্ষণে রাখার পর অবস্থার উন্নতি না হলে আবারও দেওয়া হয় চিকিৎসা। অথচ দুই দফা চিকিৎসা দেওয়ার পরও আফসানের তেমন উন্নতি হচ্ছে না। পাশের শয্যায় চিকিৎসা নিচ্ছে দুই বছর বয়সী আরেক শিশু। তার মা আসমা জানান, ১২ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয়। এর পরের বছরই প্রথম সন্তানের জন্ম। তার বয়স এখন ১২ বছর আর আসমার নিজের বয়স ২৫। দুই সন্তান ছাড়াও তাঁর ৮ বছর বয়সী আরেকটি ছেলে আছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, আসমা নিজেও রক্তশূন্যতায় ভুগছেন।
২০২১ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, রামু উপজেলায় বাল্যবিয়ের হার ৭২ শতাংশ, যা কক্সবাজার জেলার মধ্যে তৃতীয় সর্বোচ্চ। এই প্রেক্ষাপটে মার্কিন উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএইড ব্যুরো ফর হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাসিস্ট্যান্সের অর্থায়নে ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটি (আইআরসি) এবং ইয়ং পাওয়ার ইন সোশ্যাল অ্যাকশনের (ইপসা) ‘গার্ল শাইন’ প্রকল্পের মাধ্যমে রামু উপজেলায় কিশোরীদের সচেতন করে তুলছে। গত বছরের জুলাই থেকে শুরু হওয়া এক বছর মেয়াদি পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে রামুর অন্তত ৬০০ কিশোরীর বাল্যবিয়ে রোধ করা গেছে। একইসঙ্গে তাদের অভিভাবকদের অংশগ্রহণমূলক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বাল্যবিয়ের ক্ষতিকর দিক, প্রজনন স্বাস্থ্যের যত্ন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার পদ্ধতি, যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।
স্থানীয়রা বলছেন, বাল্যবিয়ের পাশাপাশি লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধেও গার্ল শাইনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এই প্রকল্পের মাধ্যমে লিঙ্গ সহিংসতার বিরুদ্ধে একটি সহযোগিতামূলক এবং নির্ভরযোগ্য সামাজিক নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হচ্ছে; যেখানে একজন কিশোরী নির্ভয়ে নিজের মত ব্যক্ত করতে পারবে। প্রয়োজনে চাইতে পারবে সহযোগিতা। সম্প্রতি গার্ল শাইনের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে নিজের বাল্যবিয়ে ঠেকিয়ে দেন কলেজছাত্রী মেহের আফরোজ। তিনি বলেন, যখন আমার মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার সময় তখন বাবা-মা বিয়ে দিতে চান। গার্ল শাইনের শিক্ষকদের মাধ্যমে আমি বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ করি।
ইপসার প্রকল্প সমন্বয়ক শমশের উদ্দিন মোস্তফা বলেন, গার্ল শাইন প্রকল্পের মাধ্যমে কিশোরীরা আত্মবিশ্বাসী ও সাহসী হয়ে উঠেছে, যা রামুর মতো পিছিয়ে পড়া অঞ্চলকে ভবিষ্যতে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এছাড়াও গার্ল শাইনের কিশোরীরা অভিভাবকদের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলতে শেখে। ফলে জড়তা ছাড়াই কিশোরীরা তাদের যে কোনো সমস্যা সমাধান করতে পারে। আগে যেমন তারা স্যানিটারি প্যাড কিনতে যেত না লজ্জায়। এখন তারা প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়েও অনেক সচেতন।
আইআরসির ডেপুটি ডিরেক্টর (প্রোগ্রামস) রেবেকা ওকেটচো বলেন, গার্ল শাইন রামুতে ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে। এর মাধ্যমে ব্যক্তিগত পর্যায়ে কিশোরীরা লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা, ক্ষমতায়ন এবং লিঙ্গসমতা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেছে। প্রকল্পের নারী পরিচর্যাকারীরা কিশোরীদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তৈরি এবং সচেতনতা সৃষ্টি করেছে।
রামু উপজেলা পরিষদের মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা উম্মে সুরাইয়া আমিন বলেন, বাল্যবিয়ে নারীর এগিয়ে যাওয়ার পথে বিরাট অন্তরায়। আমরা আমাদের দিক থেকে নারীদের প্রশিক্ষিত করার মাধ্যমে তাদের প্রয়োজনীয় উপকরণ প্রদান, অন্যান্য বিভাগের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে স্বাবলম্বী করে তুলতে চেষ্টা করে যাচ্ছি। আইআরসি, ইপসার মতো সংস্থাগুলো আমাদের সঙ্গে কাজ করছে। সবার সমন্বিত প্রচেষ্টায় বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ করা সম্ভব।
মন্তব্য করুন