ঢাকা সোমবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৩

পর্যটক জিম্মি করে ‘গলাকাটা’ ব্যবসা

পর্যটক জিম্মি করে ‘গলাকাটা’ ব্যবসা

সাজেকে পর্যটকের ঢল। ঠাঁই না পেয়ে অনেকেই রাস্তাসহ বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নেয়। শুক্রবারের ছবি: সমকাল

জাহিদুর রহমান

প্রকাশ: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ২৩:২২ | আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ২৩:২২

টানা তিন দিনের ছুটি পেয়ে অনেকেই পরিবার-পরিজন নিয়ে ছুটেছেন পাহাড়, সমুদ্র ও হাওরে। ছুটিতে দেশের প্রায় সব পর্যটনকেন্দ্রে এখন ভিড়। হোটেল-মোটেল ও রিসোর্টে ফাঁকা নেই রুম। বুকিং না দিয়ে আসায় অনেকেই পড়েছেন বিপাকে। আবার যারা আগে থেকে বুকিং দিয়েছেন, তারাও হয়েছেন প্রতারিত। এমন পরিস্থিতিতে রিসোর্ট-কটেজে কক্ষ না পেয়ে অনেক পর্যটককে রাস্তা, বারান্দা, স্টোর রুম ও গাড়িতে রাত কাটাতে হচ্ছে। অব্যবস্থাপনা, বিশৃঙ্খলা, বাড়তি ভাড়া আদায়, প্রতারণা, নিম্নমানের খাবার পরিবেশনসহ নানা হয়রানিতে ম্লান হয়েছে ছুটির আনন্দ। পর্যটক সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে প্রশাসনও। এভাবে পর্যটক বাড়লে অতিরিক্ত অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার প্রতিযোগিতা চলে। সেবা আর খাবারের মান নিয়েও সন্তুষ্ট নন পর্যটকরা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ দেশে পর্যটন ‘গলাকাটা’ ব্যবসা হয়ে উঠছে। ঈদুল আজহা, ঈদুল ফিতর, বড়দিন ও নববর্ষের মতো দিবসে ভিড় বাড়লেই বেড়ে যায় অব্যবস্থাপনা। ধরিয়ে দেওয়া হয় অতিরিক্ত বিল। পদে পদে প্রতারিত হতে হয় ভ্রমণপিপাসুদের, যা দেশি-বিদেশি পর্যটক টানতে বড় অন্তরায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের পর্যটন কর্তৃপক্ষ এ জন্য দায়ী। প্রায়ই এমন ঘটনা ঘটলেও পর্যটকদের সুরক্ষায় কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায় না।

কক্সবাজারে লোভ দেখানো ছাড়

কয়েক দিন আগেও পর্যটকশূন্য ছিল বিশ্বের দীর্ঘতম কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত। তবে গত বৃহস্পতিবার থেকে ছুটি হওয়ায় সকাল থেকেই পর্যটকের ঢল নামে। সমুদ্রসৈকতের লাবণী থেকে কলাতলী পয়েন্টের তিন কিলোমিটার এলাকা জনসমুদ্রে রূপ নিয়েছে। আজ শনিবার পর্যন্ত শহরের পাঁচ শতাধিক হোটেল-মোটেল, রিসোর্ট-গেস্ট হাউসের সব কক্ষ বুক হয়ে গেছে। তবে সপ্তাহব্যাপী বিচ কার্নিভ্যাল উপলক্ষে হোটেল-রেস্তোরাঁ, গণপরিবহন, উড়োজাহাজসহ ১৫টি খাতে সর্বোচ্চ ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড়ের যে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, তা পাননি বলে অভিযোগ করেছেন পর্যটকরা।

পর্যটন-সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, তিন দিনের ছুটিতে পর্যটননগরী কক্সবাজারে ঘুরতে এসেছেন লাখো পর্যটক। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সপ্তাহব্যাপী পর্যটন মেলা ও বিচ কার্নিভ্যাল। এ কারণে উৎসবে মেতেছে পুরো কক্সবাজার। শুধু সমুদ্রসৈকত নয়, পর্যটকরা ছড়িয়ে পড়েছেন জেলার আকর্ষণীয় পর্যটন স্পটগুলোতে। তাদের জন্য সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে ট্যুরিস্ট পুলিশ ও জেলা প্রশাসন। আগামী ৩ অক্টোবর পর্যন্ত চলবে বিচ কার্নিভ্যালের নানা অনুষ্ঠান। ফলে আরও পর্যটকের আগমন ঘটবে।

মেলা উপলক্ষে হোটেল-মোটেল, গেস্ট হাউস-কটেজ এবং রেস্তোরাঁয় ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ ছাড়ের ঘোষণা পেয়ে কক্সবাজারে গিয়ে হতাশ পর্যটকরা। তাদের অভিযোগ, বিশাল ছাড়ের খবর পেয়ে তারা কক্সবাজার এসেছেন। কিন্তু কোথাও ছাড় দিচ্ছে না। ছাড়ের কথা বললে রুম ভাড়া দিতেই রাজি হচ্ছে না। একই অবস্থা খাবার হোটেলেও।

ঢাকার মীরহাজীরবাগ থেকে আসা পর্যটক সাইলা, আঁখি ও রাফসান জানান, পর্যটক দিবস উপলক্ষে কক্সবাজার থাকার হোটেল, খাবারসহ সবকিছু ছাড় দেওয়া হচ্ছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সেটি দেখে তারা ছুটি উপভোগ করতে সৈকতে বন্ধুরা মিলে এসেছেন। তবে যে হোটেলে উঠেছেন, সেখানে ছাড় না দিয়ে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ করেন তারা।

তাদের মতো কুমিল্লা থেকে আসা পর্যটক হেমায়েত জানান, বিচ ভিউ নামে একটি হোটেলে রুমের জন্য যান। প্রথমে জানানো হয় রুম নেই। পরে একজন এসে বলে রুম আছে, তবে ৩ হাজার টাকা দিতে হবে। খাবার হোটেলে গিয়ে দেখলাম সেখানেও ছাড় নেই। এসব লোভ দেখানো ছাড়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক হোটেল ব্যবসায়ী বলেন, বেশ কয়েক মাস তাদের মন্দায় কেটেছে। তার মধ্যে মেলা উপলক্ষে জেলা প্রশাসনকে চাঁদা দিতে হয়েছে। তাই এই টাকা তুলে নিতে ছাড় দিতে পারছেন না তারা।

কক্সবাজার পর্যটক সেলের ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দজাদী মাহবুবা মঞ্জুর মৌনা বলেন, আমরা যে ছাড়ের কথা বলেছি, সেটা কার্যকর করার জন্য আমাদের আলাদা টিম কাজ করছে।

কক্সবাজার বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক গোলাম মর্তুজা হাসান বলেন, গত দু’দিনে ঢাকা, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কক্সবাজার বিমানবন্দরে ফ্লাইট নেমেছে ৪৯টি। এটা বিমানবন্দরের অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।

রাস্তায় রাত কেটেছে কয়েকশ পর্যটকের

মেঘের রাজ্যখ্যাত রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ভ্যালিতে পর্যটকের ঢল নেমেছে। টানা তিন দিনের ছুটিতে বেড়াতে এসে রিসোর্ট-কটেজে কক্ষ না পেয়ে কয়েকশ পর্যটক রাস্তা, বারান্দা, স্টোর রুম ও গাড়িতে রাত কাটিয়েছেন।

সাজেক রিসোর্ট-কটেজ মালিক সমিতি সূত্রে জানা গেছে, টানা ছুটি থাকায় গত মঙ্গলবারের আগে রুইলুই ভ্যালির রিসোর্ট-কটেজের সব কক্ষ আগাম বুকিং হয়ে যায়। গতকালও সারাদিন কক্ষ বুকিং ছাড়া অন্তত পাঁচ শতাধিক পর্যটক আসেন। এর মধ্যে কিছু ফিরে গেলেও অন্তত চার শতাধিক পর্যটক রুইলুই ভ্যালিতে থেকে যান।

দুপুর থেকে এসব পর্যটক বিভিন্ন রিসোর্ট-কটেজে কক্ষ খুঁজতে থাকেন, কিন্তু খালি না থাকায় কোথাও ভাড়া পাননি। পরে বিকেলের দিকে যে যেভাবে পারেন, স্থানীয় বাসিন্দাদের ঘরে ও স্টোর রুমে আশ্রয় খোঁজেন। এভাবে দুই শতাধিক পর্যটকের কোনোরকমে থাকা ও ব্যাগ-জিনিসপত্র রাখার সুযোগ হয়। আরও অন্তত দুই শতাধিক পর্যটক রাস্তা, বারান্দা ও গাড়িতে রাত কাটিয়েছেন বলে রুইলুই রিসোর্ট-কটেজ মালিক সূত্রে জানা গেছে।

রুইলুই ভ্যালির রিসোর্ট-কটেজ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জেরি লুসাই বলেন, রিসোর্ট–কটেজের কক্ষগুলো আগেই বুকিং হয়ে গেছে। কিন্তু বেশ কিছু পর্যটক কক্ষ বুকিং না নিয়ে এসেছেন। যারা কক্ষ বুকিং ছাড়া আসছেন, তারা বিপাকে পড়েছেন। তার পরও স্থানীয় বাসিন্দাদের ঘরে, স্টোর রুমগুলোয় কিছু পর্যটক রাখা হয়েছে। বাকি দুই শতাধিক পর্যটক রাস্তা, বারান্দা ও গাড়িতে রাত কাটিয়েছেন।

বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুমানা আক্তার বলেন, সাজেক পর্যটন কেন্দ্রের একটি নির্দিষ্ট ধারণক্ষমতা আছে। ধারণক্ষমতার বেশি পর্যটক এলেই রুম না পাওয়া বা বাইরে থাকার মতো সমস্যাগুলো তৈরি হচ্ছে। যেহেতু সাজেকে মূল সমস্যা হচ্ছে পানি, তাই অতিরিক্ত পর্যটক এলে পানির কারণেও অনেককে ভোগান্তি পোহাতে হয়।

বান্দরবান, রাঙ্গামাটির কাপ্তাই ও খাগড়াছড়ির বিভিন্ন স্থানে পর্যটকদের ভিড় বেড়েছে। সিলেটের ভোলাগঞ্জ ও সাদাপাথর, সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরসহ বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্র ভ্রমণপিপাসুদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছে।

পরিকল্পনা জরুরি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামশাদ নওরীণ বলেন, বাংলাদেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে প্রতিদিন কত সংখ্যক পর্যটক যাওয়া-আসা করছেন তার সঠিক তথ্য নেই। এ কারণে এক সময়ে কত সংখ্যক পর্যটককে আপ্যায়ন করা সম্ভব বা ধারণক্ষমতা কত, সেটি বোঝা যায় না। এ কারণে মাত্রাতিরিক্ত পর্যটকের ভিড় হয়।

তিনি বলেন, এই পরিস্থিতি এড়াতে পর্যটকদের সংখ্যা ও ধারণক্ষমতা জেনে অনুমতি দিতে হবে। এ জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করে ব্যবস্থাপনা ভালো ও পর্যটন এলাকাগুলোকে আকর্ষণীয় করতে হবে।

বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবু তাহের মো. জাবের বলেন, গত দু’দিনে শুধু কক্সবাজারেই ৫ লাখেরও বেশি পর্যটক প্রবেশ করেছেন। সারাদেশের পর্যটনকেন্দ্রে ৫০ লাখের বেশি হবে। তবে সঠিক সংখ্যা এখন বের করা যায়নি। তিনি বলেন, বিশেষ দিনগুলোতে পর্যটকের ঢল নামায় কিছু অব্যবস্থাপনা দেখা দিচ্ছে। এ অবস্থায় জনবল সংকটের কারণে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও হিমশিম খাচ্ছে।

আরও পড়ুন