ক্যাপাসিটি চার্জের বোঝা টানতে হবে অনেক বছর

সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২ অক্টোবর ২০২৩ | ১৮:০০
পরিকল্পনা অনুসারে চাহিদা না বাড়লেও দেশে বাড়ছে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা। এখনই উৎপাদন সক্ষমতার ৫০-৬০ শতাংশ বসে থাকে। আগামী দিনগুলোতে অলস বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিমাণ আরও বাড়বে। তবে উৎপাদনে না থাকলেও চুক্তি অনুসারে ক্যাপাসিটি বা রেন্টাল চার্জ নামে পরিচিত ভাড়া পায় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। গত সাড়ে ১৪ বছরে বেসরকারি কেন্দ্রমালিকরা এই খাতে প্রায় ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা পেয়েছে সরকারের কাছ থেকে। পাইপলাইনে রয়েছে আরও ৫৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র। যেগুলো চালু হলে ক্যাপাসিটি চার্জের বোঝা টানতে হবে ২০৫০ সাল পর্যন্ত।
খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র মালিকদের সঙ্গে চুক্তিতে ক্যাপাসিটি চার্জ নির্ধারণের ক্ষেত্রে সরকার নিজের স্বার্থ রক্ষা করেনি। স্বল্প মেয়াদের কথা বলে বেশি চার্জ ধরে কেন্দ্র অনুমোদন করে বছর বছর মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। পাশাপাশি বেশি বেশি চাহিদা ধরে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ও ব্যয়বহুল কেন্দ্র অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, যা মূলত ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষা করেছে। জনগণের ওপর চাপিয়েছে বিলের বাড়তি বোঝা। সরকারের এই ভুল পরিকল্পনার মাশুল দিতে এখন চাপে অর্থনীতি।
সরকারি সংস্থার প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে ভুল পরিকল্পনার তথ্য। গত জুলাইয়ে পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক প্রতিবেদনে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়ে সমালোচনা করা হয়। বিষয়টিকে ‘লুটেরা মডেল’ বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে। পরে প্রতিবেদনটির ওই অংশ সংশোধন করে প্রস্তুতকারী দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধেই নেওয়া হয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রক্ষণাবেক্ষণ ও পিক টাইমের লোড ব্যবস্থাপনার জন্য চাহিদার চেয়ে ১৫-২০ শতাংশ বেশি উৎপাদন সক্ষমতা থাকা উচিত। অবশ্য বিদ্যুৎ বিভাগের মতে, চাহিদার চেয়ে উৎপাদন ক্ষমতা ৩০ শতাংশ বেশি হওয়া প্রয়োজন।
দেশের বর্তমান গ্রিড বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে ২৪ হাজার ৯১১ মেগাওয়াট। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রকৃত উৎপাদন হয়েছে গড়ে মাত্র ১০ হাজার ৯৭ মেগাওয়াট, যা মোট উৎপাদন ক্ষমতার ৪০.৫৩ শতাংশ। অর্থাৎ প্রায় ৬০ শতাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস বসে ছিল বছরজুড়ে। শীতকালে এটি ৭০ শতাংশ পেরিয়ে যায়।
সংশোধিত পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যান (২০১৬) অনুযায়ী, ২০৩০ সালে বিদ্যুতের চাহিদার প্রাক্কলন করা হয়েছে ৩৭ হাজার ২৪ মেগাওয়াট। বর্তমানে চুক্তি সই করা ১১ হাজার ৬০৯ মেগাওয়াটের আরও ৩০টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন। চুক্তি সই প্রক্রিয়া এবং দরপত্র প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে ৩ হাজার ক্ষমতার আরও ২৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র।
যত বিদ্যুৎকেন্দ্র হবে ব্যবসায়ীদের তত লাভ হবে, আর সরকারের কমিশনভোগীদের পকেট ভরবে বলে মন্তব্য করেছেন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম। তিনি বলেন, এতে ক্যাপাসিটি পেমেন্টের চাপ বাড়বে। খরচ সামলাতে সরকার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে জনগণের পকেট কাটবে।
সম্প্রতি জাতীয় সংসদে ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়ে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর দেওয়া তথ্যানুযায়ী, বর্তমান সরকারের তিন মেয়াদে গত ৩০ জুন পর্যন্ত ৭৩টি আইপিপি (স্বতন্ত্র বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী) ও ৩০টি রেন্টাল (ভাড়ায় চালিত) বিদ্যুৎকেন্দ্রকে প্রায় ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা কেন্দ্র ভাড়া দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়েছে সামিট গ্রুপ। কোম্পানিটি ৯টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ভাড়া পেয়েছে প্রায় ১৭ হাজার ৬১০ কোটি টাকা। যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল ৭ কেন্দ্রের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ পেয়েছে ৮ হাজার ৩১০ কোটি টাকা। ইউনাইটেড গ্রুপ ছয়টি কেন্দ্রের বিপরীতে ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়েছে ৭ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকা।