ধোঁকা দিতে বড় চুল, অপারেশনে নারীর অবয়ব

কোলাজ
সাহাদাত হোসেন পরশ
প্রকাশ: ২৮ এপ্রিল ২০২৪ | ০১:২২ | আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০২৪ | ১৮:২১
ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ধোঁকা দিতে বড় বড় চুল রেখে নারীর অবয়ব নিয়েছিল ডাকাতিতে অংশ নেওয়া কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সদস্যরা। সংগঠনটির চার সন্ত্রাসীর সুনিপুণ ছকে ডাকাতির ওই দুর্ধর্ষ অভিযান ‘সফল’ হয়। পুরোভাগে থেকেই ডাকাতির আদ্যোপান্ত দেখভাল করে তারা। এরই মধ্যে তাদের নাম-পরিচয় জানতে পেরেছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। বান্দরবানের থানচি ও রুমায় কমান্ডো কায়দায় ব্যাংক ডাকাতি ও অস্ত্র লুটের ঘটনার গোয়েন্দা তথ্য ও সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করার পর এসব বিষয় সামনে এসেছে।
এদিকে, বান্দরবানে হঠাৎ কেএনএফের সশস্ত্র তৎপরতার মধ্যে বম সম্প্রদায়ের এক শীর্ষ নেতা পশ্চিমা একটি দেশে যেতে ভিসার আবেদন করেছেন। হঠাৎ তার বিদেশযাত্রার বিষয়টি গুরুত্ব দিচ্ছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। আগামী সপ্তাহে ভিসা পেলেও শেষ পর্যন্ত তিনি দেশ ছাড়তে পারবেন কিনা, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। তার বিদেশযাত্রা আটকে দেওয়া হতে পারে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।
তদন্তের সঙ্গে যুক্ত এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সমকালকে জানান, ব্যাংক ডাকাতি ও অস্ত্র লুটে কেএনএফের শতাধিক সদস্য অংশ নেয়। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের নেতৃত্ব দেয় কথিত কর্নেল ভুপাল, এনজেলিয়ানা, ফ্লেমিং ও বাপুআলপি। ঘটনার পর থেকেই ফ্লেমিং কেএনএফের নিজস্ব ফেসবুক পেজে বিবৃতি দিয়ে আসছে। ডাকাতি ও লুটের পর বান্দরবানে এখন চলছে সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, র্যাব ও আনসার বাহিনীর সমন্বিত অভিযান। এই অভিযানে গতকাল পর্যন্ত ৭৮ জন গ্রেপ্তার হয়েছে। তবে যে চারজনের ছকে কেএনএফ ব্যাংক ডাকাতি করেছে, তাদের এখনও ধরা যায়নি।
আরেকটি সূত্র বলছে, কেএনএফের গোপন তৎপরতার বিষয়টি ডাকাতির মধ্য দিয়ে সর্বসমক্ষে আসার পর একাধিক সংস্থা তদন্তে নামে।
এতে উঠে আসে, শান্তি আলোচনার মধ্যেই নিজেদের শক্তির জানান দিতে তারা দীর্ঘদিন ধরে বড় ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ছক কষছিল। কেএনএফের হাতে ভারী অস্ত্র থাকলেও ব্যাংক ডাকাতির সময় তারা সেগুলো ব্যবহার করেনি। পুরোনো অস্ত্র নিয়ে তারা ডাকাতিতে যায়। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে কেএনএফ একসঙ্গে দুই উদ্দেশ্য হাসিল করতে চেয়েছিল। প্রথমত, দেশি-বিদেশিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। দ্বিতীয়ত, কেএনএফ যে শক্তিশালী সংগঠন– এটি প্রমাণ করা; যাতে পরে যে কোনো সমঝোতা বৈঠক ও দেনদরবারে তাদের আগের চেয়ে ‘গুরুত্ব’ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে সংগঠনের জন্য কিছু টাকা সংগ্রহও ছিল লক্ষ্য। ব্যাংক ম্যানেজারকে অপহরণ করে কেএনএফ সে কারণে মুক্তিপণ দাবি করে। যদিও মুক্তিপণ দিয়ে ব্যবস্থাপক ছাড়া পেয়েছেন– এ ব্যাপারে প্রকাশ্যে কেউ মুখ খোলেননি।
কেএনএফের কর্মকাণ্ডের ওপর নজর রাখেন এমন এক কর্মকর্তা জানান, ২০২২ সালে সরকারি একটি প্রশিক্ষণে ঢাকায় এসেছিলেন কেএনএফপ্রধান নাথান বমের স্ত্রী লালসমকিম বম। তিনি পেশায় সরকারি হাসপাতালের নার্স। লালসমকিম ঢাকায় আসার সময় নাথানও সঙ্গে ছিলেন। ২০২২ সালের শেষ দিকে স্বামী-স্ত্রী রাজধানীর বাসাবোতে একটি ভাড়া বাসায় বেশ কিছুদিন থাকেন। ওই বাসাটি ভাড়া করে দেয় উগ্রপন্থি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’। নতুন এই জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে চুক্তি করে তাদের সদস্যদের পাহাড়ে নিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছিল নাথানের সংগঠন কেএনএফ। গোপন ওই সম্পর্কের সূত্র ধরে বাসাবোতে কেএনএফপ্রধানের জন্য বাসা ভাড়া করে দেয় শারক্বীয়া। পরে শারক্বীয়ার সঙ্গে কেএনএফের রসায়নের বিষয়টি সামনে এলে পাহাড়ে শুরু হয় অভিযান। ওই সময় পালিয়ে মিজোরামে চলে যান নাথান। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান চলাকালে ২০২৩ সালে গোপনে মিজোরামে যান নাথানের স্ত্রী লালসমকিম। ওই সময় নাথানের কাছে দুই ছেলেকে রেখে আসেন তিনি। নাথানের এক ছেলে সেখানকার একটি স্কুলে পড়াশোনা করছে– এমন আলোচনাও আছে। ৮ এপ্রিল রুমা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে লালসমকিমকে লালমনিরহাট ২৫০ শয্যার হাসপাতালে তাৎক্ষণিক বদলি (স্ট্যান্ড রিলিজ) করা হয়। এর পর থেকেই লাপাত্তা তিনি।
তদন্তের সঙ্গে যুক্ত এক কর্মকর্তা বলছেন, বম সোশ্যাল কাউন্সিলের এক নেতার ওপর নজরদারি রাখা হচ্ছে। হঠাৎ পশ্চিমা একটি দেশে কেন, কী কারণে তিনি যাচ্ছেন– সে ব্যাপারে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে।
ডাকাতির ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, ২ এপ্রিল রাতে কেএনএফের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা সোনালী ব্যাংক রুমা শাখার ভল্ট ভাঙার চেষ্টা করেছে। কয়েক দফায় চেষ্টা করেও ভল্ট ভাঙতে না পেরে পায়চারি করছিল তারা। তাদের পরনে ছিল সামরিক বাহিনীর মতো পোশাক। এ ছাড়া কমান্ডোদের মতো মুখে ছিল কালি মাখানো। আরেকটি সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, ৩ এপ্রিল দুপুরে থানচি থানা থেকে মাত্র কয়েকশ গজের মধ্যে সোনালী ব্যাংকে হানা দেয় কেএনএফ সদস্যরা। অস্ত্রের মুখে ব্যাংক কর্মকর্তাসহ সেবা নিতে আসা সবাইকে জিম্মি করা হয়। এ সময় ব্যাংকের ক্যাশে থাকা সব টাকাই লুট করে নিয়ে যায় তারা। ব্যাংকের ভেতরে যারা তাণ্ডব চালায়, তাদের অধিকাংশেরই ছিল বড় বড় চুল। তদন্ত সংস্থার প্রাথমিক ধারণা ছিল, কেএনএফে যোগ দেওয়া নারী সদস্যরা ডাকাতিতে অংশ নেয়। নানা গোয়েন্দা তথ্য বিশ্লেষণ করার পর বেরিয়ে আসে, সংগঠনের পুরুষ সদস্যরা নারীর অবয়ব নিয়ে ডাকাতিতে অংশ নিয়েছিল।
২ এপ্রিল রাতে কেএনএফ রুমার সোনালী ব্যাংকের ভল্ট ভেঙে টাকা লুটের চেষ্টা করে। টাকা নিতে না পেরে ব্যাংকের ব্যবস্থাপককে অপহরণ ও পাহারায় থাকায় পুলিশ-আনসারের ১৪ অস্ত্র লুট করে। পরদিন দুপুরে থানচির সোনালী ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংক থেকে ১০ লক্ষাধিক টাকা লুট করে তারা।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে গ্রেপ্তার ৭৮ জনের মধ্যে একজন চালক আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। কেএনএফ সদস্যরা ঘটনার দিন তার গাড়িতে করে রুমায় এসেছিল। এ ছাড়া সোনালী ব্যাংকের অপহৃত ব্যবস্থাপক নেজাম উদ্দিনও আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। রুমা ও থানচির ঘটনায় ৯টি মামলা হয়েছে। কেএনএফের সন্ত্রাসী তৎপরতার পেছনে ভূরাজনৈতিক তৎপরতা রয়েছে কিনা তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মিজোরাম ও চিন প্রদেশ নিয়ে আলাদা একটি রাজ্য গঠনের প্রচেষ্টার গোপন তৎপরতা তাদের রয়েছে বলে তথ্য মিলেছে। পূর্ব তিমুর ও দক্ষিণ সুদানের আদলে তারা এটি করার অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। কেএনএফ তাদের ফেসবুক পেজে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাইছড়ি, বিলাইছড়ি এবং বান্দরবানের রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি, লামা ও আলীকদম– এই ৯ উপজেলা নিয়ে ‘কুকি-চিন রাজ্য’ গঠন করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছে।
এ পরিস্থিতিতে কেএনএফের সশস্ত্র সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন বান্দরবানের ১২ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সামাজিক নেতারা। এ জন্য ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি’ নামে একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে। গতকাল পর্যন্ত সেই আহ্বানে সাড়া দেয়নি কেএনএফ। উল্টো আত্মগোপনে থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হুংকার দিয়ে যাচ্ছে। কেএনএফ এক ফেসবুক পোস্টে বলেছে, ‘পূর্বপুরুষের ভূমি রক্ষায় একবিন্দু ছাড় নয়। পাহাড়-পর্বত ও বন-জঙ্গল সংরক্ষণের দায়িত্ব কেএনএফের।’ বম সোশ্যাল কাউন্সিলের সাংগঠনিক সম্পাদক সসাংপুই বম বলেন, শান্তির আহ্বানে সাড়া না দেওয়ায় কেএনএফের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে মানববন্ধন করা হবে।
বান্দরবানের পুলিশ সুপার সৈকত শাহীন বলেন, নারী সেজে কেএনএফের সদস্যরা ডাকাতিতে অংশ নিয়েছিল বলে তথ্য পাচ্ছি। পুলিশ ও আনসারের লুট হওয়া অস্ত্র অল্প সময়ের মধ্যে উদ্ধার করা যাবে। জড়িত অন্যদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
- বিষয় :
- কেএনএফ