ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৭ জুলাই ২০২৫

এনামুলনামা

কালো টাকা সাদাতেও দেন কর ফাঁকি

বেতন পেয়েছেন ৯৩ লাখ সম্পদ ২২ কোটি টাকার

কালো টাকা সাদাতেও দেন কর ফাঁকি

মোহাম্মদ এনামুল হক

 আনোয়ার ইব্রাহীম

প্রকাশ: ০৮ জুলাই ২০২৪ | ০১:০২

জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের মামলার আসামি কাস্টমস কমিশনার মোহাম্মদ এনামুল হক ২০২২ সালে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ নিয়েছিলেন। টাকা সাদা করতে গিয়ে রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তা হয়েও নিজেই দেন কর ফাঁকি। এ ছাড়া তিনি যে স্থাবর সম্পত্তি বিক্রির চেষ্টা করছিলেন, সেটার ইঙ্গিতও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলার এজাহারে ছিল। এ তথ্য জেনেও দুদককে সম্পদ জব্দের (ক্রোক) উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। এ সুযোগে রাজধানীর কাকরাইলের দুটি ফ্ল্যাট চার কোটি টাকায় বিক্রির পাশাপাশি আরও সম্পত্তি বিক্রির চেষ্টায় ছিলেন তিনি। এনামুলের বিরুদ্ধে করা দুদকের মামলার  এজাহার সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

জ্ঞাত আয়বহির্ভূত প্রায় ১০ কোটি টাকার সম্পদ অর্জনের দায়ে গত ৩০ জুলাই দুদকের ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১-এ মামলাটি করেছিলেন সংস্থার সহকারী পরিচালক মাহবুবুল আলম। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিচালক ফারজানা ইয়াসমিন গত বৃহস্পতিবার ঢাকা মেট্রোপলিটন সিনিয়র স্পেশাল জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেনের আদালতে এনামুলের সম্পদ জব্দের আবেদন করেন। আদালত আবেদন গ্রহণ করে এনামুলের সম্পদ জব্দের আদেশ দেন। তবে গত বৃহস্পতিবার আদেশ হলেও গতকাল রোববার পর্যন্ত এনামুলের কোনো সম্পদ জব্দ হয়নি। জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা ফারজানা ইয়াসমিন সমকালকে বলেন, জব্দের কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন।

এর আগে গেল শুক্রবার সমকালের প্রথম পাতায় ‘দুই ফ্ল্যাট বেচে দেওয়ার পর এলো ক্রোকের নির্দেশ’ শিরোনামে এনামুলের অবৈধ সম্পদ নিয়ে সংবাদ প্রকাশ হয়।

টাকা সাদা করতেও কর ফাঁকি
রাজস্ব নিয়ে কাজ করা এনামুল হকের দায়িত্ব, কেউ যাতে কর ফাঁকি দিতে না পারেন। তবে এমন দায়িত্ব কাঁধে থাকলেও তিনি নিজেই কর ফাঁকিতে মাতেন। 
২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে নির্দিষ্ট হারে কর দিয়ে অর্থের উৎস বিষয়ে প্রশ্ন করা হবে না– এমন সুবিধাসহ কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়েছিল সরকার। সুযোগটা নিয়ে নেন কাস্টমসের এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তাঁর বিরুদ্ধে করা মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, এনামুল আয়কর অধ্যাদেশ, ১৯৮৪-এর ১৯এএএএএ ধারায় মোহাম্মদপুরের বাবর রোডের সারা সন্ধানী লাইফ টাওয়ারের দুটি সম্পূর্ণ ফ্লোরের (প্রতিটি ৫ হাজার ৫ বর্গফুট) বাণিজ্যিক স্পেস ২ কোটি ৫৭ লাখ ১৩ হাজার ১০০ টাকায় কেনার ঘোষণা দেন। উল্লিখিত ভবনে তাঁর কেনা ১ হাজার ১৯ বর্গমিটার বাণিজ্যিক স্পেসের বিপরীতে প্রতি বর্গমিটার ১ হাজার ৩০০ টাকা হিসাবে পরিশোধযোগ্য আয়কর ১৩ লাখ ২৪ হাজার ৮৮২ টাকা এবং হারাহারি ১ দশমিক ৭৮৫ কাঠা বা ১১৯.৪০ বর্গমিটার জমির বিপরীতে প্রতি বর্গমিটার ৫ হাজার টাকা হিসাবে পরিশোধযোগ্য আয়কর ৫ লাখ ৯৬ হাজার ৯৯৫ টাকা। অর্থাৎ বাণিজ্যিক স্পেসের বিপরীতে পরিশোধযোগ্য কর ছিল ১৯ লাখ ২১ হাজার ৮৭৭ টাকা। তিনি আয়কর অধ্যাদেশ, ১৯৮৪-এর ১৯এএএএএ ধারায় আয়কর পরিশোধ করেন ১০ লাখ ৮৭ হাজার ৪৫০ টাকা।

এজাহারে দুদক কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, আয়কর আইনের উল্লিখিত ধারায় সুবিধা নিতে হলে আরও যে ৮ লাখ ৩৪ হাজার ৮২৯ টাকা পরিশোধ করার দরকার ছিল, তা তিনি করেননি। এ কারণে আইনের সুবিধা তিনি পেতে পারেন না এবং তাঁর প্রদর্শিত ২ কোটি ৫৭ লাখ ১৩ হাজার ১০০ টাকার আয়ের উৎস গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয়নি।

সম্পদ বিক্রির চেষ্টা ছিল আগেই
দুদক কর্মকর্তা মাহবুবুল আলম কাস্টমসের এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলার এজাহারে লেখেন, এনামুল ১৯৯৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত ২১ কোটি ৫২ লাখ ৫৩ হাজার ১২ টাকা মূল্যের স্থাবর সম্পদ এবং ৫৮ লাখ ৩২ হাজার ৩১৯ টাকার অস্থাবর সম্পদ মিলে মোট ২২ কোটি ১০ লাখ ৮৫ হাজার ৩৩১ টাকার সম্পদ অর্জন করেছেন। একই সময়ে তিনি ৫ কোটি ৭৮ লাখ ৭৫ হাজার ৪৩৮ টাকা ঋণ ছিল বলে দাবি করেছেন। তবে ঋণের বিপরীতে প্রামাণ্য রেকর্ডপত্র দেখাতে ব্যর্থ হন। এজাহারে উল্লেখ করা হয়, এনামুল ফ্ল্যাট বিক্রির শর্তে ১ কোটি ১৩ লাখ টাকা এবং জমি বিক্রির শর্তে ২০ লাখ টাকা বায়না নিয়েছেন। এ বায়নার টাকাকেও তিনি ঋণ হিসেবে তুলে ধরেন।

প্রায় এক বছর আগে এজাহারে এমন তথ্য উল্লেখ করে মামলা করলেও দুদকের তরফ থেকে এ বিক্রি ঠেকাতে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ধারণা করা হয়, দুদকের মামলার কথা জেনেই এনামুল ঢাকার কাকরাইলের দুটি ফ্ল্যাট বিক্রি করে দেন। 

জানতে চাইলে নিম্ন আদালতে দুদকের আইনজীবী জাহাঙ্গীর হোসেন দুলাল সমকালকে বলেন, এজাহারে বিক্রির চেষ্টার কোনো ইঙ্গিত থাকলে তদন্ত কর্মকর্তার উচিত ছিল তখনই এজাহারে উল্লিখিত সম্পদ জব্দের জন্য আদালতে আবেদন করা। এজাহার দেওয়ার পর আসামি কোনো সম্পদ বিক্রি করে থাকলে এর অর্থ, তিনি এজাহারটি জেনে সম্পদ বিক্রি করছেন।
এভাবে এজাহারে উল্লেখ থাকা সম্পদ বিক্রি করে দিলে দুদকের পদক্ষেপ কী করবে– এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এজাহারভুক্ত সম্পদ যার দখলেই থাকুক না কেন, দুদক আদালতের আদেশ অনুযায়ী স্বাভাবিক নিয়মে জব্দ করতে পারবে। যদি এমন হয়, ওই সম্পদ কিনে কেউ ভোগদখল করছেন, তাহলে তিনি আদালতের কাছে এসে এর প্রতিকার চাইতে পারবেন।

অনুসন্ধান ও তদন্ত পর্যায়ে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ বিক্রির চেষ্টা করছেন– এমনটি জানার পরও কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা দায়িত্বে গাফিলতি করেছেন বলে মনে করেন ব্যারিস্টার তানজিব উল আলম। তিনি বলেন, এখন ওই বিক্রি হওয়া সম্পদ জব্দের আদেশ হয়ে থাকলে ক্রেতাকে আদালতের কাছে যেতে হবে। তিনি যদি প্রমাণ করতে পারেন যে এ বিষয়ে কিছু জানতেন না, তাহলে আদালত নিশ্চয়ই ন্যায়বিচার করবেন।

এনামুলের বিক্রি হওয়া কাকরাইলের আইরিস নূরজাহান টাওয়ারের এ-১৩ নম্বর ফ্ল্যাটটি কিনেছেন মক্কা ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসের স্বত্বাধিকারী এম এ রশীদ শাহ সম্রাট। গতকাল বিকেলে তিনি বলেন, এনামুল নয়, আমি ফ্ল্যাটটি কিনেছি পাশের নাসির উদ্দিন টাওয়ারের মাতৃছায়া প্রপার্টিজের কাছ থেকে। সম্রাট বলেন, ফ্ল্যাটটি যে এনামুলের এবং এটা নিয়ে যে মামলা আছে, তা জানতাম না। ব্যাংক ঋণ নিয়ে ফ্ল্যাটটি সাফ-কবলা দলিলমূলে কিনেছি।

বেতন এক কোটি টাকার কম, সম্পদ ২২ কোটি
দুদকের মামলার এজাহার সূত্রে আরও জানা গেছে, এনামুল হক ২০০৮-০৯ অর্থবছর থেকে আয়কর রিটার্ন জমা দিচ্ছেন। ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত তিনি বেতন পেয়েছেন মোট ৯৩ লাখ ৫১ হাজার ৮৬৯ টাকা। তবে এ সময়কালেই তিনি ঢাকা, চট্টগ্রাম ও ফেনীতে মোট ১৭ কোটি ৭৭ লাখ ১৯ হাজার ২৫৮ টাকা মূল্যের সম্পদ অর্জনের তথ্য দিয়েছেন। 
বেতনের বাইরে এ সময়ে স্থায়ী সঞ্চয় (এফডিআর) থেকে ১৪ লাখ ৮৯ হাজার ৭৬ টাকা সুদ পেয়েছেন। কৃষি থেকে আয় করেছেন ৮ লাখ ৭৭ হাজার ২০০ টাকা। মাছের খামার থেকে ৮৯ লাখ ৬৫ হাজার ৮৬৬ টাকা আয় করেন। গৃহসম্পত্তি থেকে ৩ কোটি ৭৪ লাখ ৩৯ হাজার টাকা আয় করেছেন বলেও নথিতে উল্লেখ করেছেন। লিজ থেকে আয় করেন ১৫ লাখ টাকা। বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স পেয়েছেন ১৯ লাখ ৯৫ হাজার ৩৭২ টাকা। বিশেষ ভাতা ও পুরস্কার হিসেবে আয় করেছেন ৫১ লাখ ২৫ হাজার ২৩৬ টাকা। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে পাওয়া বোনাস শেয়ারের মূল্য ছিল ৩ লাখ ৬০ হাজার ৬৬৮ টাকা। সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ থেকে আয় করেন ২ লাখ ৪৭ হাজার ৩৮০ টাকা।

এ ছাড়া সোয়া সাত লাখ টাকার জমি দান হিসেবে পেয়েছেন। আবার হেবাসূত্রে ৩ কোটি ৯৬ লাখ ৬৬ হাজার টাকার সম্পদ পাওয়ার তথ্য দিয়েছেন। একইভাবে মায়ের কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা নগদে দান হিসেবে পেয়েছেন বলেও উল্লেখ করেন এনামুল।

এজাহার সূত্রে পাওয়া তাঁর সম্পদ বিবরণী পর্যালোচনায় দেখা গেছে, তিনি ১৯৯৯ সালে ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার জি-ব্লকের তিন কাঠা করে মোট ছয় কাঠার দুটি প্লট কেনেন ২৩ লাখ ৫৫ হাজার টাকায়। এ দুই প্লটের পর প্রতি ফ্লোরে ৩ হাজার ২০০ বর্গফুট করে মোট ৯টি ফ্লোরের ভবন করতে ২ কোটি ৬৫ লাখ ৪৬ হাজার টাকা খরচ দেখিয়েছেন। বসুন্ধরার এ জমি ১৯৯৯ সালে কিনলেও কবে ভবনটি করেছেন, তা জানা যায়নি।

তবে এজাহারে উল্লিখিত স্থাবর সম্পদের রেজিস্ট্রেশন বছর পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এ কর্মকর্তা মূল সম্পদ গড়েছেন ২০১৩ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত। এ সময়কালে কাগুজে হিসাবে বা জমি, ফ্ল্যাট ও বাণিজ্যিক স্পেসের রেজিস্ট্রেশন মূল্য দেখিয়েছেন ১৭ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে ২০১৩ সালে পৌনে ২ কোটি টাকা, ২০১৫ সালে ২ কোটি ৪০ লাখ টাকা, ২০১৭ সালে আড়াই কোটি টাকা, ২০১৮ সালে সোয়া ২ কোটি টাকা, ২০১৯ সালে ২ কোটি ৯২ লাখ টাকা, ২০২০ সালে ২ কোটি ৭৩ লাখ টাকা, ২০২১ সালে ১ কোটি ১৫ লাখ টাকার সম্পদ কিনেছেন বলে তথ্য দিয়েছেন।

 

আরও পড়ুন

×