পুষ্টিবাড়ি: বসতবাড়িতেই পুষ্টির জোগান

আধুনিক পদ্ধতিতে নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য উৎপাদন করার সমন্বিত চাষ পদ্ধতির নাম দেয়া হয়েছে ‘পুষ্টিবাড়ি’। ছবি: সংগৃহীত
আনোয়ার হোসেন
প্রকাশ: ১১ জুলাই ২০২৪ | ১৬:১৩ | আপডেট: ১১ জুলাই ২০২৪ | ১৮:০৩
ইউনিসেফের তথ্যমতে, অপুষ্টির কারণে বাংলাদেশে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের ২৮ শতাংশ খর্বকায় এবং ১০ শতাংশ কৃশকায়তায় ভোগে। যেসব শিশু অপুষ্টিতে ভোগে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হয় এবং তাদের অন্যান্য রোগ সংক্রমণের ঝুঁকিও বেশি হয়ে থাকে। অপর্যাপ্ত সেবা ও বারবার সংক্রমণের প্রভাব, সেই সাথে শাক-সবজি, ফলমূল এবং প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার যেমন ডিম, মাছ, মাংস এবং ডাল থেকে পর্যাপ্ত পুষ্টি না পাওয়ার কারণে অপুষ্টি দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। এটি মানুষের স্বাভাবিক বৃদ্ধি এবং বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করার মাধ্যমে মানুষকে প্রতিবন্ধীত্বের দিকেও ঠেলে দিতে পারে। আর এমন পরিস্থিতির স্থায়ী সমাধান হতে পারে ‘পুষ্টিবাড়ি’। যেখানে মানুষ একইসঙ্গে নিজের জন্য এমনকি আশেপাশের মানুষদের জন্যও সরবরাহ করতে পারে পুষ্টি সমৃদ্ধ অর্গানিক খাবার।
‘পুষ্টিবাড়ি’ মূলত এমন একটি সমন্বিত চাষ পদ্ধতি, যেখানে আধুনিক কৃষি পদ্ধতি ব্যবহার করে নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য উৎপাদন করা হয়। যা সারাবছর পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিতের পাশাপাশি বসতবাড়ির সীমিত জমি ব্যবহার করে পরিবারের আয় বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। এই মডেলটিতে যেসব আধুনিক চাষ পদ্ধতি রয়েছে তা হলো, বায়ো-ইনটেনসিভ হোমস্টেড গার্ডেনিং মডেলের মাধ্যমে সবজি চাষ, উন্নত পদ্ধতিতে পোলট্রি চাষ, ছোট পুকুরে বছরব্যাপী মাছ চাষ, পোকামাকড় রোগ নিয়ন্ত্রণে জৈব সার ও জৈব কীটনাশকের ব্যবহার।
এই পদ্ধতিতে হোমস্টেড স্পেস প্ল্যানিংয়ের মাধ্যমে বসতবাড়ির ১১ ধরনের জায়গার পরিকল্পনা করা হয়ে থাকে। গ্রামের মধ্যবিত্ত থেকে নিম্ন আয়ের মানুষরা, যাদের এমনকি আলাদা কোনো চাষের জমি নেই তারাও নিজেদের উঠানেই করতে পারবেন সবজির চাষ। আবার একই জায়গায় সবজির পাশাপাশি হাঁস-মুরগী, মাছ, সবই চাষ করা যায়। পুষ্টি বাড়ি পদ্ধতিতে কেউ বাড়ির উঠানে বাঁশের মাচা করে যেমন বিভিন্ন শাক, সবজি, লাউ, শিমের চাষ করতে পারেন তেমনি বাঁশের মাচার নিচে বা পাশে করতে পারেন ছোট্ট পুকুর। একইসঙ্গে পুকুরের উপরে বা পাশে করতে পারেন হাঁস-মুরগীর খামার। ফলে অল্প পরিসরে প্রতিটি জায়গার উপযুক্ত ব্যবহারের মাধ্যমে সকলেই নিজেদের প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাবারের যোগান নিজেরাই করতে পারেন। এই চাষ পদ্ধতিতে উৎপাদিত সবজি, ডিম, হাঁস-মুরগী নিজেরা খেয়ে বাজারে বিক্রি করে বাড়তি আয়ও করা সম্ভব।
আর এই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিয়ে ‘পুষ্টিবাড়ি’ ধারণাকে সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের কাছে পৌঁছে দিয়েছে সঙ্গ (SONGO) প্রকল্পটি। কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধার চরাঞ্চলগুলোতে পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার, সঠিক স্বাস্থ্যসেবা ও স্যানিটেশন সুবিধার অভাবে বেশিরভাগ পরিবারই, অপুষ্টির শিকার। পুষ্টি বিষয়ক সচেতনতা ও সুঅভ্যাস গড়ে তুলতে ৬টি উপজেলার ১৮টি ইউনিয়নে পরিচালিত হয়ে আসছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের আর্থিক সহায়তায় কর্ডএইড ও আরডিআরএস বাংলাদেশ-এর যৌথ উদ্যোগে বাস্তবায়িত প্রকল্প ‘সঙ্গ’।
প্রকল্পের আওতায়, উত্তরবঙ্গের ১ হাজা ৮০০টি মডেল পরিবার তাদের বসতবাড়িকে ‘পুষ্টিবাড়ি’ বা নিউট্রিশন হোমে পরিণত করেছে। প্রতিটি পরিবারের পুষ্টির চাহিদা মেটাতে প্রকল্পটি নিয়োগ দেয় পুষ্টি বিক্রয় প্রতিনিধি বা নিউট্রিশন সেলস এজেন্ট। যারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে অন্যান্য স্বাস্থ্য তথ্যের পাশাপাশি মানুষকে উন্নত চাষবাস পদ্ধতি, বাড়ির উঠানে কীভাবে শাক-সবজির চাষ করতে পারবে সে বিষয়ক তথ্য ও বিভিন্ন সার, বীজ ব্যবহারের সঠিক সময় সম্পর্কে মানুষকে প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদান করে থাকে।
এছাড়া, যারা ‘পুষ্টিবাড়ি’ করতে চান তাদেরকে দেওয়া হয় প্রয়োজনীয় কারিগরি প্রশিক্ষণ। উঠান বৈঠকের মাধ্যমে নিয়মিত তাদের কার্যক্রমের অগ্রগতির খোঁজ খবর রাখা হয়। এভাবে বিভিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমে প্রকল্প এলাকার এক একটি বাড়িকে গড়ে তোলা হয় পরিপূর্ণ ‘পুষ্টিবাড়ি’ হিসেবে।