সরকার চাইলে কোটা পদ্ধতি পরিবর্তন করতে পারবে

কোলাজ
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১২ জুলাই ২০২৪ | ০১:১৮
সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে দেওয়া রায়ের মূল অংশ প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট। এতে বলা হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধা কোটার পাশাপাশি সব কোটা বজায় রাখতে হবে। তবে সরকার চাইলে বা প্রয়োজন মনে করলে সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করতে পারবে। আর কোটা পূরণ না হলে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দিতে পারবে।
এ বিষয়ে তাৎক্ষণিক সরকারের নীতিনির্ধারকদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে জানা গেছে, রায় পর্যালোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে সরকার। আজকালের মধ্যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সরকারের মনোভাব তুলে ধরতে পারেন।
বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াত সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ স্বাক্ষরের পর গতকাল বৃহস্পতিবার এক পৃষ্ঠার রায় প্রকাশ করেন। এতে বলা হয়, ২০১২ সালে করা এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের দেওয়া রায় ও আদেশ, ২০১৩ সালের লিভ টু আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে আপিল বিভাগে তা বহাল ও সংশোধিত আদেশ এবং ২০১১ সালের ১৬ জানুয়ারির অফিস আদেশের (মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতনির কোটা) আলোকে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বা নাতি-নাতনিদের জন্য কোটা পুনর্বহাল করতে বিবাদীদের নির্দেশ দেওয়া হলো। একই সঙ্গে জেলা, নারী, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, উপজাতি-ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জন্য কোটাসহ যদি অন্যান্য থাকে, কোটা বজায় রাখতে নির্দেশ দেওয়া হলো। এ বিষয়ে যত দ্রুত সম্ভব, আদেশ পাওয়ার তিন মাসের মধ্যে পরিপত্র জারি করতে নির্দেশ দেওয়া হলো।
রায়ে আরও বলা হয়, বিবাদী (সরকার) প্রয়োজন মনে করলে কোটা হ্রাস, বাড়ানো ও শতকরা হার পরিবর্তন-পরিবর্ধন করতে পারবে। কোটা থেকে চাকরিপ্রার্থী পাওয়া না গেলে সাধারণ মেধা তালিকা থেকে শূন্য পদ পূরণ করায় বিবাদীর স্বাধীনতা রয়েছে।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর সরকারি চাকরিতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে কোটা পদ্ধতি তুলে দিয়ে পরিপত্র জারি করে সরকার। এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৫ জুন ওই পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। এর পর ৯ জুন হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। ওই দিন আবেদনটি শুনানির জন্য আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে পাঠান চেম্বার আদালত।
এর পর থেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলন করছেন চাকরিপ্রত্যাশী ও শিক্ষার্থীরা। কয়েক দিন মিছিল ও মানববন্ধন করলেও এ সপ্তাহের শুরু থেকে তারা সড়ক অবরোধ কর্মসূচি ‘বাংলা ব্লকেড’ পালন করছেন। আন্দোলনকারীরা শুরুতে চার দফা দাবিতে বিক্ষোভ করলেও এখন তারা মাঠে এক দফা নিয়ে। তাদের দাবি, সব গ্রেডে সব ধরনের ‘অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক’ কোটা বাতিল করে সংবিধানে উল্লিখিত অনগ্রসর গোষ্ঠীর জন্য কোটাকে ‘ন্যূনতম পর্যায়ে’ এনে সংসদে আইন পাস করে কোটা পদ্ধতি সংশোধন করতে হবে।
এই আন্দোলনের মধ্যেই ১০ জুলাই কোটা নিয়ে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের ওপর চার সপ্তাহের স্থিতাবস্থা জারি করেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ এ আদেশ দেন। কিছু পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশনা দিয়ে সর্বোচ্চ আদালত বলেন, কোটা নিয়ে এখন কোনো কথা বলা যাবে না। হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলে আপিল বিভাগ আবার বিষয়টি শুনবে। একই সঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষ ও শিক্ষার্থীদের হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল করতে বলেন আদালত। এ বিষয়ে পরবর্তী শুনানির জন্য আগামী ৭ আগস্ট দিন ধার্য রয়েছে। এ অবস্থায় গতকাল হাইকোর্টের রায়ের মূল অংশ প্রকাশ করা হলো।
‘বল এখন সরকারের কোর্টে’
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. শাহ্দীন মালিক বলেছেন, ‘সরকার যেহেতু হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে আপিল করেছে এবং হাইকোর্টের রায় বের হয়েছে, সরকার এখন আপিল প্রত্যাহার করলেই পারে। আবেদনে সরকার বলবে, আপিল করব না, রায় মেনে নিয়েছি। এর পর সরকার সবার সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়ে নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করতে পারে। সব মিলিয়ে বল এখন সরকারের কোর্টে।’
তবে কোটা নিয়ে সরকারের পরিপত্র বাতিলের দাবিতে হাইকোর্টে রিট আবেদনকারীদের আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী বলেন, ‘রায়ে সব কোটা বজায় রাখতে বলা হয়েছে। তবে প্রয়োজনে সরকার তা কমাতে বা বাড়াতে পারবে। আপিল বিভাগ স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে আদেশ দিয়েছেন। ফলে এ রায় এখনই বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না।’
এদিকে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিনউদ্দিন বলেন, ‘আংশিক রায় সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই। কখনও শুনি নাই হাইকোর্টে আংশিক রায় প্রকাশ হয়। হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হতে হবে। রুলসে আছে, প্রকাশ্যে আদালতে রায় ঘোষণা করতে হবে।’
জোরালো হয়েছে সরকারের অবস্থান
সংস্কারের মাধ্যমে কোটা ব্যবস্থা যৌক্তিক পর্যায়ে রাখতে সরকারের ইতিবাচক মনোভাব আগেই দেখা গেছে। বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধা, নারী, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও প্রতিবন্ধীদের কোটা আংশিক থাকতে পারে বলে মত দিয়েছে সরকার। গত সোমবার সরকারের পাঁচ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর বৈঠকেও এমন অভিমত আসে। এখন হাইকোর্টের রায়ের মূল অংশে যে নির্দেশনা রয়েছে, তা সরকারের অবস্থানকেই জোরালো করেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে সরকারের এমন অবস্থান তুলে ধরেন। কোটা পদ্ধতি থাকার পক্ষে মত দেওয়ার পাশাপাশি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুলের ‘মুক্তিযোদ্ধা কোটার প্রয়োজন নেই’– এমন মন্তব্যের কঠোর সমালোচনা ও শিক্ষার্থীদের অবস্থানের বিরোধিতা করেন তিনি। ওবাদুল কাদের বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা কোটা না রাখার পক্ষে বক্তব্যের মাধ্যমে বিএনপি যে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী এবং তাদের মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযাদ্ধাদের প্রতি কোনো সম্মানবোধ নেই, এটাই আবার প্রমাণ হয়েছে।’
সেতুমন্ত্রী আরও বলেন, ‘গত পাঁচ বছরে কোটা না থাকায় নারীরা পিছিয়ে গেছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী। বৈচিত্র্যময় ও সমতাভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠনে কোটার গুরুত্ব রয়েছে। কোটা কোনো বৈষম্য নয়। বরং বৈষম্য নিরসনে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কোটার প্রয়োজন।’
এদিকে সচিবালয়ে পৃথক ব্রিফিংয়ে জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘মেয়েদের এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিতে হবে। অনেক জেলা এখনও পিছিয়ে। ১৭টি জেলা থেকে একজনও পুলিশে সুযোগ পায়নি। তাই যৌক্তিক সমাধান হওয়া প্রয়োজন।’ মালদ্বীপ, ভারত ও পাকিস্তানে সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা রয়েছে বলে এ সময় মন্তব্য করেন তিনি।
- বিষয় :
- কোটা সংস্কার আন্দোলন