আটকের পর খোঁজ জানেন না স্বজন
‘সাদা পোশাক’ আতঙ্কে বিএনপি নেতাকর্মী
আদালতে সোপর্দের পর ‘স্বস্তি’

লোগো
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৩ আগস্ট ২০২৪ | ০১:০৩ | আপডেট: ০৩ আগস্ট ২০২৪ | ১১:১৩
বিএনপিসহ বিরোধীদলীয় নেতাকর্মী ও তাদের স্বজনরা এখন রয়েছেন ‘সাদা পোশাক’ আতঙ্কে। যারা আটক বা গ্রেপ্তার অভিযানে আসেন তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গোয়েন্দা, নাকি অপহরণকারী– তাও নিশ্চিত হওয়া যায় না। তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশের কাছে প্রতিকার এবং পরিচয় নিশ্চিত হতে চাইলেও কোনো তথ্য না পাওয়ায় শঙ্কায় থাকেন নেতাকর্মীরা।
আটকদের যতক্ষণ আদালতে সোপর্দ করা না হয়, ততক্ষণ তারা এক ধরনের ট্রমায় থাকেন বলে অভিযোগ পরিবারের।
সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সারাদেশে দায়ের করা মামলায় বিএনপির অনেক নেতাকর্মীই আসামি। ফলে তারা এখন ঘরছাড়া। এ মামলা ঘিরে চলছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযান। রাতে কিংবা দিনে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এর মধ্যে একটি বড় অংশকে সাদা পোশাকের গোয়েন্দা সংস্থা আটক করছে বলে জানা গেছে।
বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, গ্রেপ্তার নেতাকর্মীর বেশির ভাগকেই সাদা পোশাকে তুলে নেওয়া হচ্ছে। এর পর এক-দুই দিন পর আদালতে সোপর্দ করা হয়। এই সময়ে পরিবার, স্বজনসহ অন্যরা থাকেন ভয়ংকর এক আতঙ্কে। বিভিন্ন মাধ্যমে খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেন– তাদের স্বজনকে কোথায় নেওয়া হয়েছে; সে কেমন আছে। তাদের অনেকে সংশ্লিষ্ট থানায় জিডি করতে চাইলেও থানা-পুলিশ সেই জিডি গ্রহণ করে না বলে তাদের অভিযোগ। এ রকম একটি পরিস্থিতিতে যখন তারা জানতে পারেন আটক স্বজনকে আদালতে তোলা হচ্ছে বা তোলা হয়েছে তখন তাদের একটু স্বস্তি ফিরে আসে।
নেতাকর্মীর পরিবারের অভিযোগ, আটক অভিযান পরিচালনার সময়ে সাদা পোশাকে থাকা ব্যক্তিরা নিজেদের কোনো পরিচয় দেন না। তাদের কারও পরিচয় দৃশ্যমান থাকে না। যে গাড়িতে তারা আসেন, সেসবেরও কোনো পরিচয় বহন করেন না। ফলে কারা তাদের স্বজনকে নিয়ে যাচ্ছেন, তা কেউ বুঝতে পারেন না। কোনো অপরাধী চক্র এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে যে কোনো দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে বলেও শঙ্কা তাদের।
গত বুধবার রাত ১টার দিকে বিএনপিপন্থি পেশাজীবী অ্যাসোসিয়েশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ-অ্যাবের সহসভাপতি প্রকৌশলী কামরুল হাসান উজ্জ্বলকে তাঁর রাজধানীর বনশ্রীর বাসা থেকে সাদা পোশাকের লোকজন তুলে নিয়ে যায়। এ সময় একজন পুলিশের পোশাকে ছিলেন; বাকি সবাই হেলমেট ও মাস্ক পরা অবস্থায় ছিলেন বলে তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়। এ সময় তারা তিনটি গাড়িতে করে ২০ থেকে ২২ জন এসেছিলেন এবং সবার হাতে ছিল লাঠি। তাদের কারও কারও চুল অনেক বড় ছিল। তারা পুলিশ, নাকি ডিবি তার সঠিক তথ্যও দেয়নি। প্রথমে বাড়িতে ঢুকেই সিসি ক্যামেরা ভেঙে ফেলে অভিযানকারীরা। বাড়ির মালিক অপরিচিত লোকজনকে দেখে স্থানীয় থানায় ফোন দিলে পুলিশ জানায়, তারা থানা থেকে কাউকে পাঠায়নি। পরে কামরুলের পরিবার এবং অ্যাবের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়।
গত ১৯ জুলাই রাত ৩টার দিকে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরকে আটক করে সাদা পোশাকের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাঁর স্ত্রী মারিয়া নুর অভিযোগ করে বলেন, ওইদিন রাতে এক ধাক্কায় দরজা ভেঙে চ্যাংদোলা করে নুরকে নিয়ে গাড়িতে ওঠায়। বাইরে তখন একটি অ্যাম্বুলেন্সসহ সাতটি গাড়ি ছিল। তাঁর কাছে মনে হয়েছে– এর মধ্যে একটি গাড়ি র্যাবের আর বাকিগুলো ডিবির। তবে তারা কেউ পরিচয় জানাননি।
একই ঘটনা ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব আমিনুল হকের ক্ষেত্রেও ঘটেছে। তাঁকে গ্রেপ্তারের প্রায় এক দিন পর দলের নেতাকর্মীরা জানতে পারেন।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে আড়াল করতে বিএনপির নির্দোষ নেতাকর্মীর বাড়িতে বাড়িতে অভিযান চালাচ্ছে। বাসায় না পেয়ে তাদের সন্তান অথবা পরিবারের সদস্যদের আটক ও অশালীন আচরণসহ আসবাবপত্র ভাঙচুর করা হচ্ছে। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার মিথ্যা অভিযোগে ঢালাওভাবে বিএনপি ও বিরোধী দলের নেতাকর্মীর ওপর সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দোষারোপ করছে। তবে বিএনপির কোনো নেতাকর্মীই কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত নন বলে দাবি করেন তিনি।
বিএনপি নেতাদের দাবি, গত এক সপ্তাহে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমান, জহিরউদ্দিন স্বপন, দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানী, চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, দলের কোষাধ্যক্ষ রশিদুজ্জামান মিল্লাত, সাংগঠনিক সম্পাদক কাজী সাইয়েদুল হক বাবুল, প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু, আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার নাসিরউদ্দিন অসীম, ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক সাইফুল আলম নিরব, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক রফিকুল আলম মজনু, মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব আমিনুল হক, ঢাকা জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নিপুণ রায় চৌধুরীসহ দলের তিন হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিএনপি ছাড়াও বিজেপি চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর, ১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক ও জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদাসহ বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীকে আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে উত্তরখান থেকে ডিবি পরিচয়ে আটক করে ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সহসভাপতি মাহবুবুল আলমকে। এর এক ঘণ্টা পর একই বাসা থেকে তাঁর পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী কলি, স্ত্রীর বড় ভাই কামরুল হাসান ও তাঁর স্ত্রী আয়েশা আক্তারকে নিয়ে যাওয়া হয়।
ওই পরিবারের ঘনিষ্ঠ ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপি নেতা কচি আহমেদ জানান, মাহবুবকে নিয়ে যাওয়ার পর সাদা পোশাকের লোকজন আবার বাসায় আসেন, চা খান। এরপর বলেন, মাহবুব অনেকটা নির্দোষ। তবে আপনারা যদি ডিবি কার্যালয়ে গিয়ে সুপারিশ করেন তাহলে হয়তো তাঁকে মুক্তি দেওয়া হতে পারে। সাদা পোশাকের লোকজনের এমন আশ্বাসে পরিবারের তিন সদস্য তাদের সঙ্গে যান।
- বিষয় :
- বিএনপি