ঢাকা বুধবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

চারদিকে বানের ক্ষত, ঘুরে দাঁড়ানোই হবে চ্যালেঞ্জ

মৃত্যু বেড়ে ৩১

চারদিকে বানের ক্ষত, ঘুরে দাঁড়ানোই হবে চ্যালেঞ্জ

ফেনীতে বন্যার পানি নামতে শুরু করলেও দুর্ভোগ কমেনি। বন্যায় পুরো শহর জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। দুর্ভোগে বন্যার্ত মানুষ। ছবি: স্টার মেইল

জাহিদুর রহমান, ফেনী থেকে

প্রকাশ: ২৯ আগস্ট ২০২৪ | ০৬:৩৭ | আপডেট: ২৯ আগস্ট ২০২৪ | ০৬:৩৭

ধীরগতিতে নামছে বানের পানি। অনেকেই ছাড়ছেন আশ্রয়কেন্দ্র। এতদিন যে জনপদ ডুবন্ত ছিল, পানি সরতেই ভেসে উঠছে ধ্বংসযজ্ঞ। বিধ্বস্ত ঘর, এবড়োখেবড়ো রাস্তাঘাট, ভাঙা ব্রিজ, ভেঙে পড়া বিদ্যুতের খুঁটি, ধসে পড়া অবকাঠামো ধরা পড়ছে চোখে।  পথে পথে যেন বন্যার ক্ষত।

বিধ্বস্ত ঘরে আতঙ্ক নিয়েই উঠছেন কেউ কেউ, আবার অনেক ঘর থেকে পানি না সরায় ছাড়েননি আশ্রয়কেন্দ্র। ফেনী শহর থেকে পানি সরলেও ফুলগাজী, ছাগলনাইয়া ও পরশুরামের ঘরবাড়ি ডুবে আছে এখনও। নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুরে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। এতে পানিবন্দি লাখ লাখ মানুষ নতুন করে দুর্ভোগে পড়েছেন। 

এদিকে, ত্রাণ বিতরণে সমন্বয়হীনতার জন্য প্রশাসনকেই দুষছেন অনেকে। স্থানীয়রা বলছেন, প্রচুর ত্রাণ এলেও সমন্বয় নেই। প্রশাসনের ব্যক্তিদের অনেকটা গা-ছাড়া ভাব। এখন পর্যন্ত বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের তালিকা কিংবা গ্রামে গ্রামে কমিটি গঠনের কাজটিও শেষ হয়নি। উপজেলা চেয়ারম্যানরা না থাকায় এ তালিকা করতে সমস্যা হচ্ছে। সড়কের পাশের বাড়িঘর ও আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর মানুষজন একাধিকবার ত্রাণ পাচ্ছেন। কিন্তু প্রত্যন্ত এলাকায় পর্যাপ্ত ত্রাণ যাচ্ছে না। এমন বিশৃঙ্খলা চলতে থাকলে মানুষের দুর্ভোগ আরও বাড়ার শঙ্কা রয়েছে। ১১ জেলার মধ্যে ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও কুমিল্লা– এ চার জেলার বানভাসি মানুষ আছে বেশি কষ্টে। 

এদিকে, কবে ঠিক হবে রাস্তাঘাট, মাথা গোঁজার ঠাঁই হারানো মানুষ কোথায় আশ্রয় নেবে– এসব প্রশ্নের উত্তর জানা নেই কারও। বিধ্বস্ত পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে স্থানীয় প্রশাসনেরও নেই তেমন উদ্যোগ। মানুষের ভোগান্তি দূর করতে প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। 

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় গতকাল বুধবার জানিয়েছে, দেশের ১১ জেলায় চলমান বন্যায় এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ৩১ জন। মঙ্গলবার এ সংখ্যা ছিল ২৭। ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, লক্ষ্মীপুর ও কক্সবাজারের ৭৩ উপজেলা বন্যায় প্লাবিত। ১২ লাখ ২৭ হাজার ৫৫৪টি পরিবার এখনও পানিবন্দি। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ৫৮ লাখ ২২ হাজার ৭৩৪। বিধ্বস্ত এক জনপদ প্রবাসী অধ্যুষিত ফেনী জেলা অর্থনৈতিক দিক থেকে সমৃদ্ধ এক জনপদ, ব্যবসা-বাণিজ্যেও এগিয়ে। তবে পুরো জেলায় এখন চলছে হাহাকার। চার দিকেই ভঙ্গুর দশা। গতকাল ফেনীর মহিপাল থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের লেমুয়া পর্যন্ত সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, রাস্তাঘাট ভেঙে একাকার। পানির স্রোতে মহাসড়কে তৈরি হয়েছে বড় বড় গর্ত। সড়ক বিভাজকে থাকা গাছগুলো ভেঙে পড়ে আছে। ফলে যান চলছে স্বাভাবিকের চেয়ে কম গতিতে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কনটেইনারবাহী লরি যেমন বিপদে পড়ছে, তেমনি বিপাকে পড়ছে ত্রাণের গাড়ি।

ফেনীর লালপোল ও লেমুয়া ব্রিজ বানের তোড়ে ভেঙে গেছে। পরশুরামের কাউতলী ইউনিয়নের চম্পকনগর-কাশীনগরসহ বেশ কয়েকটি গ্রামে যোগাযোগের সড়ক মুহুরী নদীর বাঁধের ওপর করা। বাঁধটি বিভিন্ন স্থানে এমনভাবে ভেঙেছে, এখন হেঁটে চলাচল করা কষ্টকর। এক রকম যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এ এলাকায় ত্রাণও পৌঁছাচ্ছে না সহজে। অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দুর্যোগের পর প্রথম সোমবার চিড়া-মুড়ির মতো শুকনো খাবার এসে পৌঁছায় কাশীনগরে।

বন্যায় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফেনীর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতাল। বিকল হয়ে আছে জেনারেটর। পানিতে তলিয়ে নষ্ট হয়ে গেছে বহু যন্ত্রপাতি। একই অবস্থার খবর পাওয়া গেছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ অন্য সেবা প্রতিষ্ঠানের।

এ ছাড়া ফেনী, কুমিল্লা ও নোয়াখালীর আঞ্চলিক এবং গ্রামীণ সড়কগুলোও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যা ও বৃষ্টির পানির চাপে ধসে পড়েছে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের  মুছাপুর স্লুইসগেট (রেগুলেটর)। পরে সেটি পুরোপুরি ধসে ছোট ফেনী নদীতে বিলীন হয়ে যায়।

ফেনীতে ত্রাণ বিতরণে অংশ নেওয়া স্বেচ্ছাসেবক সিরাজুল ইসলাম বলেন, বন্যায় সব গ্রামীণ সড়ক, উপজেলা সদরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনকারী সড়কের অনেক ক্ষতি হয়েছে। পানির প্রবল তোড়ে ভেসে গেছে অনেক সড়কের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এসব সড়কে এখন চলাচল কঠিন হয়ে পড়েছে।

ফেনী শহর থেকে পানি নামলেও ময়লা-আবর্জনার ছড়াছড়ির কারণে দুর্গন্ধে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। এ ছাড়া সড়কের ওপর ময়লা স্তূপ করে রাখায় কোনো কোনো এলাকায় যান চলাচলে সমস্যা দেখা দিচ্ছে।

সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের ফেনী অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী (সড়ক বিভাগ) বিনয় কুমার পাল বলেন, পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে মহাসড়কে সংস্কার কাজ শুরু হয়েছে। ক্ষতবিক্ষত সড়ক সংস্কার করতে প্রাথমিকভাবে অন্তত এক সপ্তাহ  লাগবে। পরে মহাসড়ককে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে আরও কিছুদিন লাগবে। স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে কাজ চলছে। তিনি বলেন, বন্যার পানি একেবারে নেমে গেলে প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতির চিত্র পাওয়া যাবে। বন্যায় জেলা সদর, উপজেলা সদর, ইউনিয়ন, হাটবাজারের সঙ্গে সংযোগ সড়কগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন এসব সড়কে যাতায়াতে কষ্ট হচ্ছে সাধারণ মানুষের।

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) জানিয়েছে, ১১ জেলায় বন্যায় প্রাথমিকভাবে ৬ হাজার ৫৪২ কিলোমিটার রাস্তা এবং ১ হাজার ৬৬টি ব্রিজ ও কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ পর্যন্ত ৩৪ কিলোমিটার রাস্তা এবং ৬৯টি ব্রিজ ও কালভার্ট মেরামত করেছে এলজিইডি।

স্থানীয় উন্নয়নকর্মী নুরুল আলম মাসুদ বলেন, ফেনী অঞ্চলের মানুষের বন্যা মোকাবিলা করার অতীত অভিজ্ঞতা নেই। পানি নামতে শুরু করার পর নতুন করে জীবন গুছিয়ে নেওয়াটা আরেক চ্যালেঞ্জ। চিরচেনা ঘরের অনেক কিছুই এ সময়টায় অচেনা হয়ে পড়ে।  এমন পরিস্থিতিতে স্থানীয় প্রশাসনের অনেকেই বদলি আতঙ্কে থাকায় দুর্গত মানুষের সেবায় তেমন ভূমিকা রাখছেন না। এ ছাড়া উপজেলা চেয়ারম্যানরা না থাকায় সংকট আরও বেড়েছে। তিনি বলেন, গত তিন যুগে ফেনী, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুরে বড় বন্যা হয়নি। ফলে বন্যার পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়নি। এবারের বন্যা থেকে শিক্ষা নিয়ে ওই এলাকায় পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। 

ঘুরে দাঁড়ানোর নতুন চ্যালেঞ্জ

আগে কখনও পানি ওঠেনি ঘরে, সে চিন্তা থেকে তেমন কোনো প্রস্তুতিও ছিল না। হঠাৎ পানি ঢুকে অল্প সময়ের মধ্যে ঘর ডুবে যায়। নিজে বাঁচতে আর পরিবারের সদস্যদেরও রক্ষা করতে তাৎক্ষণিক যে যেভাবে পেরেছেন, কোথাও না কোথাও ঠাঁই নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কেউ আশ্রয় নেন ঘরের চালে, কেউ ঘরের সিলিংয়ে, কেউবা তড়িঘড়ি উঠে পড়েন গাছে। পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে দুর্গত মানুষ ঘরে ফিরে এসে দেখেন সব শেষ। গোলাভরা ধান, ঘরে পালা হাঁস-মুরগি সবকিছুই ভেসে যায় বানের জলে। এ পরিস্থিতিতে বন্যাকবলিত এলাকার মানুষের সামনে এখন কঠিন চ্যালেঞ্জ।  

ফেনীর ছাগলনাইয়া পৌর এলাকার বাসিন্দা ওমর ফারুকের টিনের বেড়া দেওয়া ঘরটি থেকে পানি নেমে গেছে। গতকাল তিনি এসে দেখেন কোনো আসবাবই আর ঠিক নেই।  টিনের বেড়ার নিচের অংশ ভেঙে দুমড়েমুচড়ে গেছে। কিছু মাটি দিয়ে ঘরটি টিকিয়ে রাখতে চেষ্টা করছিলেন তিনি। ওমর ফারুকের বাড়ির পাশে দেখা যায়, একটি বাড়ি পুরো ভেঙে পড়ে আছে। ঘরের টিন সরিয়ে এক পাশে স্তূপ করে রাখছিলেন আমেনা বেগম। সেখানে দাঁড়িয়ে আমেনার সঙ্গে কথা হয়, কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আন্নে যিয়ানে দাঁড়াই রইছেন, হিয়ানে আঁর ঘর আছিল। অন নাই। অন আঁই কোনায় থাকুম। নোয়া ঘর কেন্নে বানামু। আঁর সব শ্যাষ ওই গেল।’

ত্রাণ ব্যবস্থাপনায় হযবরল 

ত্রাণ বিতরণে এক ধরনের হযবরল অবস্থা দেখা দিয়েছে। অনেকে একাধিকবার ত্রাণ পেলেও কারও ভাগ্যে জুটছে না কিছুই। যারা ত্রাণ নিয়ে যাচ্ছেন তারা  মূল সড়কের পাশে আশ্রয় নেওয়া কিংবা আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা ব্যক্তিদের মাঝে ত্রাণ  বিতরণ করছেন। বিপুলসংখ্যক মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে পারেননি। নিজ বসতবাড়িতে পানিবন্দি হয়ে অসহনীয় দিন কাটাচ্ছেন। এ রকম বিপুলসংখ্যক মানুষ এখনও ত্রাণবঞ্চিত।

ছাগলনাইয়ার বাসিন্দা মহিউল্যাহ বলেন, ফেনী মানে ফেনী শহর আর মহিপাল নয়– ফেনী অনেক বড় জেলা, প্রায় ১৬ লাখ মানুষের বাস। গত পাঁচ দিন দুর্গম এলাকায় বিদ্যুৎ নেই, একটা মোমবাতি নিয়েও যায়নি কেউ। মাঝে-মধ্যে কেউ কেউ এসে প্রধান সড়ক দিয়ে কয়েকটা প্যাকেট ছুড়ে ভিডিও করে চলে যায়।

ফেনী ছাড়িয়ে নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুরেও এখন পানি বাড়ছে। সোমবার সন্ধ্যায়ও যেখানে পানি ছিল না, গতকাল সেখানে কোমরসমান পানি। ঘরে রান্না নেই, শুকনো খাবার শেষ। কিন্তু নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুরের গ্রামগুলোতে ত্রাণ যাচ্ছে কম।

ত্রাণ নিয়ে ব্যক্তি উদ্যোগে ফেনীতে গিয়েছিলেন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত আলী আহমেদ। তিনিও সমন্বয়হীনতা অভিযোগ করে বলেন, ফেনীতে প্রচুর ত্রাণের গাড়ি আসছে। যে যেভাবে পারছে ত্রাণ দিচ্ছে। কিন্তু ফেনীর স্থানীয় প্রশাসনের তেমন তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। বন্যাবিষয়ক কোনো তথ্যই প্রশাসনের কাছে নেই। কোথায় ত্রাণ দরকার তাও প্রশাসন জানে না। দুর্গত এলাকা ম্যাপিং এবং তালিকা বানানো জরুরি। সে অনুযায়ী ফেনীর তিনটি প্রবেশমুখে সরকারিভাবে ত্রাণের গাড়িগুলো সমন্বয় করে যেখানে বেশি চাহিদা সেখানে পাঠানো উচিত।

এ দিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক রাজৈনতিক নেতা বলেন, আমরা জেলা প্রশাসকের কাছে গিয়েছিলেন ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমে সহায়তার হাত বাড়াতে। তবে এখনও সরকারি কার্যক্রমে আমাদের সম্পৃক্ত করা হয়নি। ফলে আমরা নিজেদের মতো করে যতটুকু পারছি সহায়তা করছি।

জেলা প্রশাসক মোছাম্মৎ শাহীন আক্তার বলেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের মাধ্যমে তালিকা করে সরকারি ত্রাণ সহযোগিতা দেওয়া হবে। অনেক স্বেচ্ছাসেবক জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় ত্রাণ দিচ্ছেন।

আরও পড়ুন

×