ঢাকা মঙ্গলবার, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

চিকিৎসাহীন দুর্বিষহ এক দিন, মেলেনি জরুরি সেবাও

শর্তসাপেক্ষে কর্মসূচি স্থগিত, বন্ধ থাকবে বহির্বিভাগসহ অন্যান্য সেবা

চিকিৎসাহীন দুর্বিষহ এক দিন, মেলেনি জরুরি সেবাও

চিকিৎসক ধর্মঘটের কারণে মুমূর্ষু রোগীদেরও ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। স্বজনকে নিয়ে এভাবেই অনেকে পড়েছেন বিপাকে। অ্যাম্বুলেন্সে রোগী বসিয়ে অপেক্ষার এমন দৃশ্য রোববার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে। ছবি: সমকাল

 সমকাল প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ০১:৩২ | আপডেট: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ১৩:৫৩

টিকিট কাউন্টার বন্ধ। বহির্বিভাগ বন্ধ। রোগ নির্ণয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা বন্ধ। এমনকি জরুরি বিভাগেও তালা। দিনভর হয়নি কোনো অস্ত্রোপচার। গতকাল রোববার দেশের বৃহত্তম চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের দৃশ্য এটি। সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত ১০ ঘণ্টা সব ধরনের সেবা বন্ধ রেখেছিলেন চিকিৎসকরা। এতে অবর্ণনীয় দুর্ভোগে পড়েন রোগীরা। চলে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে রোগী ও তাদের স্বজনের ছোটাছুটি।

শুধু ঢাকা নয়, বাইরের সরকারি হাসপাতালগুলোতেও পরিস্থিতি ছিল কমবেশি একই রকম। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সব ধরনের চিকিৎসাসেবা বন্ধ করে দেওয়া হয় দুপুর থেকে। সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, খুলনা মেডিকেল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালেও সেবা বন্ধ করে দেন চিকিৎসকরা।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ভাঙচুর ও মারধরের ঘটনার বিচার ও নিরাপত্তার দাবিতে চিকিৎসকদের ডাকা ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির কারণে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। 
ঢামেক হাসপাতালের বহির্বিভাগ ও জরুরি বিভাগে প্রতিদিন পাঁচ হাজারের বেশি রোগী আসেন। রোববার হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, জরুরি বিভাগের ভেতরে শতাধিক রোগীর অবস্থান। চিকিৎসাসেবা না পেয়ে অনেকের ভেতরে আতঙ্ক। তার রোগীর কী হবে? বিপদ হবে না তো? জরুরি চিকিৎসা বন্ধ করে দেওয়ায়ও অনেকে ক্ষুব্ধ।

স্ট্রোক করায় জামালপুর থেকে ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে আমেনা বেগমকে। চিকিৎসকদের কর্মবিরতির কথা শুনে তাঁকে ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগে শুইয়ে রাখা হয়েছে। তাঁর মেয়ে সুলতানা বেগম বলেন, শনিবার রাতে মা স্ট্রোক করেন। স্থানীয় হাসপাতালে গেলে চিকিৎসকরা ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যেতে বলেন। রোববার সকালে এসে দেখি, এখানে চিকিৎসকদের কর্মবিরতি চলছে। এখন মায়ের চিকিৎসা কোথায় করাব? মায়ের অবস্থা ভালো না। স্পষ্ট কথা বলতে পারছেন না। কাউকে চিনতে পারছেন না। এখনই চিকিৎসা না পেলে মাকে বাঁচানো সম্ভব নয়।
৫ আগস্ট আন্দোলনে গিয়ে যাত্রাবাড়ী এলাকায় ছররা গুলি লাগে আরাখ খানের। গতকাল সকালে তিনি জরুরি সমস্যায় পড়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান চিকিৎসা নিতে। কিন্তু সেবা পাননি। যন্ত্রণায় ভুগছিলেন। তিনি সমকালকে বলেন, হাসপাতালে এসে দেখি কর্মবিরতি চলছে। চিকিৎসকদের দেখা নেই। আমরা চিকিৎসা পাব কীভাবে?

সৌদিপ্রবাসী আফরোজা দুই মাসের জন্য ঢাকা এসেছেন। ২৬ আগস্ট ঢামেকে ১০৯ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি হন। তাঁর পিত্তথলিতে পাথর। রোববার অস্ত্রোপচার করার কথা ছিল। তবে কর্মবিরতির কারণে তা হয়নি। ভোগান্তির শিকার এই রোগীর প্রশ্ন, এখন কী করব?

বাবার চিকিৎসার জন্য কুমিল্লা থেকে ঢাকায় এসেছিলেন বিল্লাল হোসেন। তিনি বলেন, আমরা চিকিৎসকদের কর্মবিরতির কথা জানতাম না। জরুরিভিত্তিতে বাবার চিকিৎসা প্রয়োজন। সেজন্য ঢাকা নিয়ে এসেছি। এখানে এসে দেখি ভেতরে কাউকে ঢুকতে দিচ্ছে না। অনেক অনুনয় করেছি। 

কিন্তু কর্মচারীরা জানাল, জরুরি বিভাগে কোনো ডাক্তার নেই। এখন কী করব বুঝতে পাচ্ছি না।

জরুরি বিভাগ চালু ১০ ঘণ্টা পর

নিরাপদ কর্মস্থল নিশ্চিত ও হামলাকারীদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তারের আশ্বাসে সন্ধ্যায় সারাদেশে সব ধরনের চিকিৎসাসেবা বন্ধের ঘোষণা প্রত্যাহার করেন চিকিৎসকরা। গতকাল স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগমের সঙ্গে বৈঠক শেষে সোমবার রাত ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টা কর্মবিরতি স্থগিতের ঘোষণা দেন তারা। এই সময়ে তারা শুধু জরুরি সেবা দেবেন। বহির্বিভাগসহ অন্যান্য সেবা বন্ধই থাকবে। 

গতকাল বিকেলের বৈঠকে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আসাদুজ্জামানের কক্ষে এ বৈঠকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহও ছিলেন।

বৈঠক শেষে ঢাকা মেডিকেলের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, হাসপাতালের জরুরি বিভাগ, ক্যাজুয়ালিটি এবং নিউরোসার্জারিতে চিকিৎসাসহ অন্যান্য চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। একই সঙ্গে কর্মরত চিকিৎসকদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, আনসার সদস্যরা সার্বক্ষণিক হাসপাতালে থাকবেন।

স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম বলেন, চিকিৎসকদের দাবির বিষয়ে যা করা প্রয়োজন তা পূরণে চেষ্টা করবেন। এরপর চিকিৎসকরা স্বাস্থ্য উপদেষ্টার কথা না রেখে শুধু আগামী ২৪ ঘণ্টায় শর্ত সাপেক্ষে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা চালু করার ঘোষণা দেন। একজন চিকিৎসকের বিপরীতে একজন নিরাপত্তা রক্ষী থাকার শর্তে সারাদেশে জরুরি সেবা চালু হবে বলে দাবি করেছেন তারা।

বৈঠক শেষে ঢামেক হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের চিকিৎসক ডা. আব্দুল আহাদ বলেন, কর্মবিরতি স্থগিত করা হলেও শুধু জরুরি বিভাগে চিকিৎসা চালু থাকবে। আগামী ২৪ ঘণ্টা প্রতিটি জরুরি বিভাগে একজন চিকিৎসকের বিপরীতে একজন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য নিরাপত্তা দেওয়া সাপেক্ষে শুধু জরুরি বিভাগের সেবা দেওয়া হবে। এর বাহিরে বহির্বিভাগ ও অন্তর্বিভাগে সেবা স্থগিত থাকবে। তবে আইসিইউ, এইচডিইউ সেবা চলমান আছে। আগামী সাত দিন সারাদেশের চিকিৎসা কেন্দ্রগুলো এই নিয়মে চলবে। এর মধ্যে দোষীদের গ্রেপ্তার ও কর্মস্থলে চিকিৎসকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে আবারও কর্মসূচি দেওয়া হবে।

প্রসঙ্গত, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শনিবার তিন দফায় হামলা ও মারধরের ঘটনা ঘটে। এরপর রাতেই কাজ বন্ধ করে দেন ইন্টার্ন চিকিৎসকরা। অন্য চিকিৎসকরাও তাদের কর্মবিরতিতে সংহতি জানালে রোববার সকাল থেকে হাসপাতালের সব বিভাগে চিকিৎসাসেবা বন্ধ হয়ে যায়। দুপুরের পর সেবা বন্ধ করে দেয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও খুলনা মেডিকেল কলেজ।

এর আগে গত শনিবার হামলার ঘটনায় যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিতে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছিলেন চিকিৎসক ও কর্মচারীরা। তবে তার আগেই রোববার সকাল থেকে কর্মবিরতি শুরু করেন তারা। সকালে চিকিৎসকরা হাসপাতালে এসে কাজ শুরু করলেও ধীরে ধীরে তারা হাসপাতাল ত্যাগ করেন। ঢামেক হাসপাতালে সকাল ৯টার দিকে জরুরি বিভাগের কর্মকর্তারা কক্ষ বন্ধ করে দেন। এক পর্যায়ে জরুরি টিকিট কাউন্টারটিও বন্ধ হয়ে যায়। পরে দেশের অন্যান্য স্থানেও চিকিৎসকরা কর্মবিরতিতে যান। 

মুমূর্ষু রোগী ফেলে হাসপাতাল ত্যাগ
ঢাকায় ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণার পর গতকাল বিকেল ৩টা থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা বন্ধ করে দেন চিকিৎসকরা। অনেকে মুমূর্ষু রোগী ফেলে হাসপাতাল ত্যাগ করেন। পূর্ব ঘোষণা ছাড়া চিকিৎসকদের এমন কর্মবিরতিতে অচল হয়ে পড়ে পুরো হাসপাতাল। জরুরি বিভাগেও মেলেনি চিকিৎসাসেবা।

এর আগে দুপুরে চিকিৎসকদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ তসলিম উদ্দীন। বৈঠকে পরিচালক শাটডাউন কর্মসূচি থেকে সরে আসতে চিকিৎসকদের বোঝানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন এবং তাদের দাবি মেনে নেওয়ার ব্যাপারেও আশ্বাস দেন। তার পরও কর্মস্থলে যোগ দেননি তারা।

দুপুরের দিকে এক পর্যায়ে জরুরি বিভাগে তালা লাগিয়ে দেন আন্দোলনরত চিকিৎসকরা। পরে চমেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগেও চিকিৎসা মিলছে না– এমন সংবাদ পেয়ে সেখানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক রাসেল আহমেদের নেতৃত্বে একটি দল যায়। তারা তালা ভেঙে রোগীদের ভেতরে প্রবেশের সুযোগ করে দেয়। তবে চিকিৎসক না থাকায় সেবা পাননি রোগীরা।

চিকিৎসাসেবা সচল করতে তারাও হাসপাতালের পরিচালকসহ ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে দেখা করেন। তবে তাদের আবেদনে সাড়া দেননি চিকিৎসকরা। জরুরি বিভাগে প্রতিনিয়ত রোগীর সারি বাড়তে থাকায় তারাও দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। এক পর্যায়ে হ্যান্ড মাইক হাতে নিয়ে চিকিৎসকদের উদ্দেশে রাসেল আহমেদ বলেন, ‘আপনারা হলেন রোগীদের একমাত্র ভরসা। রোগীদের এভাবে জিম্মি করবেন না প্লিজ। অনেক মুমূর্ষু রোগী দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষায় থাকার পরও চিকিৎসা নিতে পারছেন না। তাই আমরা অনুরোধ করছি, আপনারা দ্রুত কর্মস্থলে যোগ দিন। আপনাদের নিরাপত্তা দেবেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শিক্ষার্থী, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা। আপনাদের দাবির বিষয়েও আমরা কথা বলব।’

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে গতকাল সন্ধ্যায় চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ তসলিম উদ্দীন বলেন, ‘চিকিৎসকদের কর্মবিরতির কারণে প্রায় তিন ঘণ্টা হাসপাতালে চিকিৎসা কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটে। জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিতে এসে অনেক রোগীকে বেগ পেতে হয়েছে। কর্মবিরতিতে গিয়ে চিকিৎসকরা জরুরি বিভাগসহ হাসপাতালের কয়েকটি অংশে তালা লাগিয়ে দেন। তবে সন্ধ্যা ৬টার পর ঢাকায় পরিস্থিতি স্থগিত ঘোষণা করার পর আবারও চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম শুরু হয়।’

চিকিৎসকদের দাবি
চিকিৎসকদের পক্ষ থেকে শনিবার হামলাকারীদের আটক ও শাস্তির পাশাপাশি সারাদেশে চিকিৎসক ও রোগীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ দুই দফা দাবি জানানো হয়। পরে গতকাল দুপুরে সারাদেশে সব চিকিৎসাকেন্দ্রে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ ঘোষণা করে চার দফা দাবি জানানো হয়– 

১. হাসপাতালের মতো জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠানে যেসব ব্যক্তি বা কুচক্রী মহল এই ন্যক্কারজনক ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তাদের চিহ্নিত করা। আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাদের গ্রেপ্তার করা। দ্রুত বিচার আইনের মাধ্যমে তাদের শাস্তির আওতায় আনা।

২. নিরাপদ কর্মস্থল নিশ্চিত করা। এ লক্ষ্যে অবিলম্বে দেশের সব স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্য পুলিশের (আর্মড ফোর্স) মাধ্যমে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

৩. নিরাপদ স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের লক্ষ্যে হাসপাতালে রোগীর ভিজিটর (ভিজিটর কার্ডধারী) ছাড়া বহিরাগত কাউকে কোনোভাবেই ভেতরে প্রবেশ করতে না দেওয়া। বিষয়টি স্বাস্থ্য পুলিশের মাধ্যমে নিশ্চিত করা।

৪. হাসপাতালে রোগীর সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে কোনো অবহেলা-অসংগতি পরিলক্ষিত হলে তা যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ আকারে জানানো। এভাবে শাস্তি নিশ্চিত করা যেতে পারে; কিন্তু কোনোভাবেই আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া যাবে না।

আরও পড়ুন

×