ঢাকা বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪

‘জানালা দিয়ে নরক দেখছি’

‘জানালা দিয়ে নরক দেখছি’

.

 দ্রোহী তারা

প্রকাশ: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ০০:০৯

‘ঘুমাইবার পারি না রাইতে ওহোনো। বুকের শ্বাস বন্ধ হয়া আহে। ১৯ জুলাই হারাদিন ছুডু পোলাডারে জড়ায়া জানালা-দরজা বন্ধ কইরা বয়া আছিলাম। আল্লাহরে ডাকছি শুধু। একবার শুধু জানালার ফাঁক দিয়া তাকাইছিলাম নরক দেখছি মনে হয়। একটা পোলা আমার চোক্ষের সামনে গুলি খাইলো। এডা আমি কেমনে ভুলমু। চাইর দিকে শব্দ আর চিক্কুর। খুব ডর লাগে ওহোনো।’
কোটা সংস্কার আন্দোলন দমনে গত ১৮-২০ জুলাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর বর্বর হামলা-হত্যাকাণ্ডের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এসব কথা বলেন রাজধানীর বাড্ডার বাসিন্দা গৃহবধূ আকলিমা (ছদ্মনাম)। সেই দিনগুলোর ভয়াবহতা বর্ণনা করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

একই রকম অনুভূতি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরও। নাম প্রকাশ না করে তিনি বলেন, ‘বিকট শব্দ শুনলে এখনও আঁতকে উঠি। রাতে আরও জেঁকে বসে আতঙ্ক। আমার কিশোর বয়সী দুই ছেলেকে মুহূর্তের জন্যও চোখের আড়াল করতে পারছি না। মাঝরাতে উঠেও তাদের ঘরে গিয়ে দেখি, ওরা ঠিকঠাক আছে কিনা। অসময়ে কেউ বাসায় এসে কলিংবেল চাপলেও আতঙ্কিত হই। অনেক রক্ত দেখেছি, এখনও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক বীভৎসতা দেখছি। এতে আরও ভেঙে পড়ছি, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছি। এই সময় কবে শেষ হবে– এটাই শুধু ভাবছি।’
শুধু বাড্ডা নয়, সেই দিনগুলোর নিষ্ঠুরতম দৃশ্য মস্তিষ্ক থেকে মুছতে পারছেন না পার্শ্ববর্তী রামপুরা, আফতাবনগর, বনশ্রী ও হাজীপাড়ার বাসিন্দারাও। জুলাইয়ে নির্মম হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি চলেছে গণগ্রেপ্তার, গভীর রাতে বাসা থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার ঘটনাও। এসব মনে পড়লেই শরীর শিহরিত হচ্ছে স্থানীয়দের। তারা এমন অস্থিরতা-ভয়াবহতা আগে কখনও দেখেননি। যেসব এলাকায় মুদি ও চায়ের দোকানের সামনে নিয়মিত আড্ডা চলত, কোলাহলে পূর্ণ থাকত– সেসব জায়গায়ও এখন সুনসান নীরবতা বিরাজ করছে। রাস্তার ধারের বিধ্বস্ত দোকানপাটগুলো মেরামত করে যারা খুলছেন, তাদের মধ্যেও ফেরেনি স্বস্তি।

আন্দোলনে সামনের সারিতে ছিলেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাদাফ। তিনি বলেন, ছাত্র-জনতাকে দমানোর জন্য পুলিশের নির্মমতা বলে শেষ করা যাবে না। তারা নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা আন্দোলনকারীদের হত্যা করার জন্য যেন ‘পাবজি গেম’ খেলেছেন। চোখের সামনে কয়েকজন গুলি খেয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন। তাদের লাশগুলোও সরানোর সুযোগ দেওয়া হয়নি। তারা এতটা নৃশংস হতে পারে– তা কেউ কল্পনাও করেনি। দৃশ্যগুলো আজও চোখে ভাসে, হৃদয় কেঁদে ওঠে।

আফতাবনগরে আবাসিক ভবনের নিরাপত্তাকর্মী রুহুল আমিন জানান, ‘চোখের সামনে এত্তুডি লাশ দেখলাম বইসা বইসা। খালি দৌড়ায়া লয়া যাইতাছে। রক্ত আর রক্ত। এহোনো বইসা থাকলে ওইডিই চোক্ষের সামনে খালি ভাইস্যা ওডে। কষ্ট লাগে ওহোনো।’
দক্ষিণ বনশ্রীতে পুলিশের গুলিতে নিহত সুমনের আত্মীয় মেজবাহ আহমেদ বলেন, পৃথিবী যেন উল্টে গেছে। কোনো কিছুতেই মন বসে না। অনেক ভীতি ও হারানোর বেদনা নিয়ে অফিস থেকে বাসা যাওয়া-আসা করি। কিন্তু রাস্তায় পুলিশের পোশাক পরিহিত কারও দিকে তাকাতে মন চায় না। তাদের ওপর থেকে শ্রদ্ধা ও ভরসা উঠে গেছে। সবসময় নিরাপত্তাহীনতা কাজ করে।
মেরাদিয়া এলাকার এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘গত ২০ জুলাইয়ের পর থেকে কারও সঙ্গে যোগাযোগ করি না। বাড্ডা এবং ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার সহিংসতার দৃশ্য দেখার পর থেকে নিজেকে আবদ্ধ করে ফেলেছি। ভয়ে বাইরে বের হওয়ার চিন্তাই করতে পারি না।’

ট্রমার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন বনশ্রীর বাসিন্দা শর্মী জাহান। তিনি জানান, ওই সময়ের বীভৎস দৃশ্যের কথা মনে হলেই তিনি অসুস্থবোধ করেন। এরপর এক দিনের জন্যও বাইরে বের হতে পারেননি। ঘরেও নিজেকে নিরাপদ ভাবতে পারছেন না। কখন যেন গুলি এসে লাগে– সেই ভয় তাড়া করে সর্বদা। তাঁর ছোট দুই ভাই বাড়ি থেকে বের হলেই না ফেরা পর্যন্ত চরম উদ্বেগ কাজ করে। হত্যাকাণ্ডে জড়িত সবার বিচার চান তিনি।

জুলাইয়ের ভয়াবহতা যারা দেখেছেন তাদের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আনার উপায় নিয়ে সাইকোলজিক্যাল হেলথ অ্যান্ড ওয়েলনেস কেয়ারের মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অন্তরা অন্তু বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলন নিয়ে মানুষের মধ্যে দু’ধরনের মানসিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। প্রথমত, সেই দিনগুলোর ভয়াবহতা যারা প্রত্যক্ষ করেছেন, তারা ট্রমার মধ্যে আছেন, কেউ কেউ ভুগছেন আফটার শকে। তারা যে মানসিকভাবে প্রচণ্ড আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন, সে অবস্থার পাশাপাশি যাদের মধ্যে কোনো শব্দ শুনলেই আঁতকে ওঠা, বিশেষ পোশাক পরিহিত লোকদের দেখলে ভীতি কাজ করা ও বাইরে বের হওয়ার ক্ষেত্রে যে ভয় কাজ করছে– তা থেকে উত্তরণ প্রয়োজন। এজন্য তাদের একাকিত্ব পরিহার করতে হবে, কোলাহলের মধ্যে থাকার চেষ্টা করতে হবে, সেই সব স্মৃতি মানুষের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে হবে, নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে জড়তা কাটাতে হবে। প্রয়োজনে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।

দ্বিতীয় বিষয়টি হলো– যারা ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আন্দোলনে অংশ নিতে পারেননি, তাদের মধ্যে আফসোস কাজ করছে। এজন্য নিজেকে হীন মনে করছেন, অপরাধবোধ করছেন। তাদের অবস্থার উন্নতির জন্য শোকাহত পরিবারের পাশে দাঁড়ানো, সহায়তা করা ও দুঃখ ভাগাভাগি করে নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে।

whatsapp follow image

আরও পড়ুন

×