বানের পানিতে ঝরছে কৃষকের নোনাজল
৩ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকার ফসলের ক্ষতি
ফাইল ছবি
জাহিদুর রহমান
প্রকাশ: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ০১:০২ | আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ০৬:৩৫
দিন পনেরো আগেও জমিতে ছিল সবুজের নাচন। নবান্নের স্বপ্ন দোল খাচ্ছিল ফেনীর ছাগলনাইয়ার কৃষক মহিউদ্দিনের হৃদয় গালিচায়। সর্বনাশা বানের জলে ভেসে গেছে তাঁর সেই স্বপ্ন। ঘামে ভেজা উপার্জনে গড়া টিনের বসতঘর লেপ্টে গেছে জলকাদায়। পুকুরের সব মাছ নিমেষেই উধাও। ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে অবসন্ন মহিউদ্দিন। কখন যে চোখের আঙিনায় জলধারা বইছে টেরই পেলেন না। এক পর্যায়ে বেদনার জল মুছতে মুছতে বললেন, ‘ঘর গেছে, মাছ গেছে, ক্ষেতের ফসলও শেষ। অন আমরা কেমনে বাঁচুম।’
ফেনী, কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালীসহ দেশের লাখো কৃষক এখন মহিউদ্দিনের মতোই বিষণ্ন। ভাদ্রের স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা কৃষকের জীবনকে করে দিয়েছে এফোঁড়-ওফোঁড়। বন্যার পানি অনেক এলাকায় নেমে গেছে। পানির নিচে থাকা এলাকার ক্ষয়ক্ষতির ছবিটা এখন আরও দগদগে। স্রোতে ঘর ভেসে গেছে, ধানক্ষেত হয়েছে বিরান। ভেসে গেছে ঘের ও পুকুর। মাঠের ধানগাছের শুধু গোড়া দেখা যায়, ওপরের অংশ নুয়ে পড়ে পচে মিশেছে মাটিতে। কোথাও কোথাও তা আবার কাদামাটির সঙ্গে মিলিয়ে গেছে। কষ্টের ফসলের এমন পরিণতিতে নির্বাক কৃষক।
বিশ্লেষকরা বলছেন, কৃষকরা যে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির শিকার হয়েছেন, তা কাটিয়ে উঠতে তাদের সহযোগিতা করা এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সব কৃষি উপকরণ সহজলভ্য ও নতুন করে পুঁজির ব্যবস্থা করা জরুরি।
৩ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকার ফসলের ক্ষতি
কৃষি মন্ত্রণালয়ের চূড়ান্ত ক্ষয়ক্ষতির হিসাব বলছে, বন্যায় ২৩ জেলায় ১৪ লাখেরও বেশি কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আউশ-আমন ধান, শাকসবজি, আদা, হলুদ, ফলবাগান, মরিচ, পান, তরমুজ, পেঁপে, টমেটোসহ বিভিন্ন ফসলের ৯ লাখ ৮৬ হাজার ২১৪ টন ফসলের উৎপাদন একেবারেই নষ্ট হয়ে গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে ধানের উৎপাদন। আমনের আবাদ ও বীজতলার যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা থেকে ৬ লাখ ৮৫ হাজার টন ধান পাওয়া যেত, যা পুরোপুরিই নষ্ট হয়েছে। এর বাইরে নষ্ট হয়েছে প্রায় ১ লাখ সাড়ে ৬ হাজার টন আউশ ধানের উৎপাদন। সব মিলিয়ে ২ হাজার ৫১৯ কোটি টাকার ধানের উৎপাদন নষ্ট হয়েছে। বন্যায় আক্রান্ত ২৩ জেলায় বিভিন্ন ফসল চাষ করা হয়েছিল ১৪ লাখ ৩০ হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে। গড়ে এ ফসলের ১৪.৫৮ শতাংশ নষ্ট হয়ে গেছে। ক্ষতির এই তালিকায় আমন-আউশ ধানের পরই রয়েছে শাকসবজি। ১ লাখ ৭৬ হাজার টন বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি নষ্ট হয়েছে– যার দাম প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ৩ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকার ফসলের ক্ষতি হয়েছে।
কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, বন্যার কারণে ১২ জেলায় ব্যাপকভাবে ফসলের ক্ষতি হয়। এর বাইরে বন্যা পরিস্থিতির কারণে আরও ১৫ জেলায় অল্প পরিমাণে বিভিন্ন ফসল ক্ষতির মুখে পড়ে। আউশ-আমনের যে পরিমাণ জমিতে বানের পানি ঢুকেছে তাতে অন্তত ৮ দশমিক ৫ লাখ টন চালের উৎপাদন নষ্ট হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে ক্ষতি ২ হাজার কোটি টাকা
এক যুগ বাহরাইনে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে নিজের জমানো টাকার সঙ্গে কিছু ঋণ নিয়ে মাছ চাষ শুরু করেছিলেন কুমিল্লার নাঙ্গলকোটের হেলাল উদ্দিন। এলাকায় থিতু হয়ে বড় উদ্যোক্তা হতে চেয়েছিলেন। তবে বন্যার পানি তাঁর সবকিছুই করে দিয়েছে এলোমেলো। হেলাল উদ্দিন জানান, ২০১২ সালে ছোট পরিসরে মাছ চাষ শুরু করলেও আস্তে আস্তে ব্যবসার পরিধি বাড়াতে থাকেন। সর্বশেষ ১২টি পুকুরে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ছেড়েছিলেন তিনি। তবে তা আর ঘরে তুলতে পারেননি। বন্যায় সব মাছ ভেসে যাওয়ায় প্রায় ১ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে তাঁর।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, ১২ জেলায় বন্যায় গবাদি পশু, হাঁস-মুরগি, পশুখাদ্য, মাছ, পোনা, অবকাঠামোসহ এখন পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। শুধু মৎস্য খাতেই ক্ষতির পরিমাণ ছাড়িয়েছে ১ হাজার ৫৯০ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। ক্ষতিগ্রস্ত পুকুর, দীঘি, খামারের সংখ্যা ১ লাখ ৮০ হাজার ৮৯৯টি। ক্ষতিগ্রস্ত মাছ ও চিংড়ির পরিমাণ ৯০ হাজার ৭৬৮ টন। ক্ষতিগ্রস্ত পোনা ও চিংড়ির পোস্ট লার্ভা ৩ হাজার ৭৪৬ লাখ এবং অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। দুধ, ডিম, গবাদি পশু, হাঁস-মুরগিসহ এখন পর্যন্ত এ খাতে ৪১১ কোটি টাকার বেশি ক্ষতির তথ্য পাওয়া গেছে।
বিশ্লেষকরা যা বলছেন
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বন্যার পর দুর্গত এলাকায় অনেক চ্যালেঞ্জ সামনে আসে। যেমন বন্যার কারণে কৃষির ব্যাপক ক্ষতি হয়। আবার নতুন করে কৃষি উৎপাদন নিয়েও দুশ্চিন্তা তৈরি হয় কৃষকদের। বীজ ও সার কোথা থেকে পাবেন, এ নিয়ে কৃষক ও বর্গাচাষিরা অনিশ্চয়তায় পড়েন। ফলে বন্যার পর এখন কৃষি পুনর্বাসনের দিকে সরকারকে দ্রুত মনোযোগ দিতে হবে। প্রণোদনা দিয়ে কৃষক ও খামারির মাথা তুলে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দিতে হবে।
সাবেক কৃষি সচিব ও কৃষি বিশেষজ্ঞ আনোয়ার ফারুক বলেন, কৃষির এত বড় ক্ষতি আগে কখনও হয়েছে মনে পড়ে না। যদি পুনর্বাসন প্রক্রিয়া সঠিকভাবে না করা যায়, তাহলে কৃষিপণ্য উৎপাদন ও দেশের খাদ্য নিরাপত্তা মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হবে। তিনি বলেন, সরকার কিছু কিছু জায়গায় কৃষকের মধ্যে বীজ ধান বিতরণ করেছে। তবে ১৫ সেপ্টেম্বরের পর অন্য ফসলে চলে যাওয়াই ভালো হবে। কারণ আর আমনের মৌসুম থাকবে না।
পুনর্বাসনে জোর সরকারের
ফসল নষ্ট হওয়া জমি দ্রুত চাষের আওতায় আনতে ইতোমধ্যে সরকার কাজ শুরু করেছে। এর মধ্যে কৃষকের পাশে দাঁড়াতে এগিয়ে এসেছেন দেশের বিভিন্ন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিআরআরআই) ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) সহায়তায় বীজ সংগ্রহ করছেন তারা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণা মাঠে শুরু হয়েছে আমন ধানের বীজতলা তৈরির কাজও। খামারির কথা চিন্তা করে পোনা উৎপাদনের উদ্যোগ নিয়েছেন রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
ভয়াবহ এ বন্যার পর কৃষি পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে নতুন করে অমন চাষে। কৃষি সচিব মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান বলেন, এ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কৃষি পুনর্বাসন। এ কার্যক্রমের আওতায় ১৯৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার আশপাশে দ্রুত আমনের বীজতলা তৈরি করা হচ্ছে– যা দিয়ে ফের আমনের আবাদ করা হবে। এ ছাড়া শাকসবজিসহ অন্য জমিতেও চাষাবাদ ফিরিয়ে আনতে কৃষককে সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়ার জন্য কাজ চলছে বলে জানান তিনি।
কৃষি উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, সারের সরবরাহ স্বাভাবিক থাকবে। সারের কোনো সংকট হবে না। যেখানে আমন উৎপাদন সম্ভব নয়, সেখানে শাকসবজিসহ উপযোগী অন্য ফসল উৎপাদন নিশ্চিত করা হবে।
প্রাণিসম্পদ খাতের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে তিনটি পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানান মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার। তিনি বলেন, জরুরি ভিত্তিতে পশুখাদ্য সরবরাহ ও বিতরণ করা হচ্ছে। গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগির রোগ প্রতিরোধে টিকা দেওয়ার পাশাপাশি ঘাসের কাটিং বিতরণ করা হচ্ছে। এ ছাড়া খামারির পুনর্বাসনে সহজ শর্তে ঋণ, প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত সহায়তা, মুক্ত জলাশয়ে পোনা অবমুক্ত কার্যক্রম চালানোর ঘোষণাও দেন উপদেষ্টা।
- বিষয় :
- বন্যা